২০২২ শেষে চলে এলো ২০২৩। থার্টি ফার্স্ট নাইট বা ইংরেজি নববর্ষর প্রথম প্রহরে উৎসব উদযাপনে মেতেছে গোটা বিশ্ব। পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় নানা আয়োজন।
আজ ১ জানুয়ারি, খ্রিষ্টীয় ২০২৩ সালের প্রথম দিন। নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা বিগত বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়ার জন্য এটা অপরিহার্য।
আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। গ্রেট ব্রিটেনে এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয় ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। এই ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আগে নাম ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিসর দেশে প্রচলিত ক্যালেন্ডারটি রোমে এনে তার কিছুটা সংস্কার করে তার রোম সাম্রাজ্যে চালু করেন। এই ক্যালেন্ডারে জুলিয়াস সিজারের নামে জুলাই মাসের নামকরণ করা হয়। মিসরীয়রা বর্ষগণনা করত ৩৬৫ দিনে। মিসরীয়দের ক্যালেন্ডার সংস্কার করে জুলিয়াস সিজার যে ক্যালেন্ডার রোমে প্রবর্তন করলেন তাতে বছর হলো ৩শ’ সাড়ে পঁয়ষট্টি দিনে। এখানে উল্লেখ্য যে, মিসরীয় ক্যালেন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দে।
কিন্তু কিভাবে পেলাম এ ইংরেজি নববর্ষ? কী তার ইতিহাস? কখন থেকে শুরু হলো এ নববর্ষ উৎযাপন? তাকি আমরা জানি? পৃথিবীর শুরু থেকেই ছিল নাকি পরে শুরু হয়েছে? আসুন! জানা অজানা কিছু বিষয় জেনে নিই। জেনে নেওয়া যাক, বর্ণিল উৎসাহে পালন করা ইংরেজি নববষের্র ইতিহাস। আমরা যে ইংরেজি সন বা খ্রিষ্টাব্দ বলি আসলে এটা হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এটা একটি সৌর সন। নানা পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, বিবর্তন এবং যোগ-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে বর্ষগণনায় বর্তমান কাঠামো লাভ করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানুষ সূর্য দেখে সময় হিসাব করত। কিংবা বলা যায়, তারও আগে মানুষ বুঝতই না সময় আসলে কী? ধারণাটা আসে চাঁদের হিসাব থেকে। অর্থাৎ চাঁদ ওঠা এবং ডুবে যাওয়ার হিসাব করে মাস এবং তারপর বছরের হিসাব করা হতো। চাঁদ ওঠার সময় বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলতো ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতো নুনেস। সূযের্র হিসাবে বা সৌর গণনার হিসেব আসে অনেক পরে। সৌর গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। কিন্তু চন্দ্র গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। বর্তমানের ইরাককে প্রাচীনকালে বলা হতো মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার ৪টা আলাদা আলাদা ভাগ আছে আর তা হচ্ছে সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষ গণনা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় কিন্তু তখন বর্তমানের মতো জানুয়ারির ১ তারিখে নতুন বর্ষগণনা শুরু হতো না। তখন নিউ ইয়ার পালন করা হতো যখনই বসন্তের আগমন হতো। অর্থাৎ শীতকালের রুক্ষতা ঝেড়ে প্রকৃতি যখন গাছে গাছে নতুন করে পাতা গজাতে থাকে, ফুলের কলিরা ফুটতে শুরু করে তখনই নতুন বর্ষ! অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও প্রাথমিক বর্ষপঞ্জিকায় অল্প পরিসরে সুমের/সুমেয়ী সভ্যতায় পরিলক্ষিত হয়। তবে মিশরীয় সভ্যতাই পৃথিবীর প্রাচীনতম সৌর ক্যালেন্ডার চালু করে বলে জানা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ সালের ১ জানুয়ারি নতুন বছর পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রোমান সিনেট। আর বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির নামকরণ করা হয় রোমানদের দেবতা জানুসের নামে। লাতিন শব্দ জানুস, অর্থ দরজা। এই দরজা মানেই ইংরেজি নতুন বছরের আগমন, ইংরেজি নতুন বছরের শুরু। জানা যায়, প্রথম মিশরীয়রা সূর্য দেখে বছর হিসাব করতে শুরু করে। যাকে তারা সৌরবর্ষ নাম দিল। কিন্তু সমস্যা হলো সূর্য দেখে হিসাব আর চন্দ্র দেখে হিসাবের অনেক পার্থক্য থাকতো। বছর গুনলে কী হবে তার হিসাব রাখা জরুরি। তাই সুমেরীয়রা বর্ষপঞ্জিকা আবিষ্কার করল। যাকে ক্যালেন্ডার বলি।
ইংরেজি নববর্ষ শুরুর ইতিহাস
গ্রিকদের কাছ থেকে বর্ষপঞ্জিকা পেয়েছিল রোমানরা। তারা কিন্তু ১২ মাসে বছর গুণতো না। তারা বছর গুনতো ১০ মাসে । মধ্য শীত মৌসুমের ৬০ দিন তারা বর্ষগণনায় আনতো না। রোমানদের বর্ষ গণনার প্রথম মাস ছিল মার্চ। তখন ১ মার্চ পালিত হতো নববর্ষ উৎসব। শীত মৌসুমে ৬০ দিন বর্ষ গণনায় না আনার কারণে বর্ষ গণনা যে দুটি মাসের ঘাটতি থাকতো তা পূরণ করার জন্য তাদের অনির্দিষ্ট দিন-মাসের দ্বারস্থ হতে হতো।
এই সব নানা জটিলতার কারণে জনসাধারণের মধ্যে তখন ক্যালেন্ডার ব্যবহার করবার প্রবণতা একেবারেই ছিল না বলে জানা যায়। রোম উপাখ্যানখ্যাত প্রথম সম্রাট রমুলাসই আনুমানিক ৭৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে রোমান সম্রাট নূমা পন্টিলাস ১০ মাসের সঙ্গে আরো দুটো মাস যুক্ত করেন। সে দুটো মাস হচ্ছে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি। রোমানরা বছর হিসাব করতো ৩শ’ চার দিনে। তিনি ‘মারসিডানাস’ নামে আরও একটি মাস যুক্ত করেন রোমান বর্ষপঞ্জিকায়। তখন থেকে রোমানরা ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করতে শুরু করে। ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন শুরু হয় সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করে।
রোমানদের আগের বর্ষপঞ্জিকা ছিল চন্দ্রবষের্র, সম্রাট জুলিয়াসেরটা হলো সৌরবষের। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ সালের ১ জানুয়ারি নতুন বছর পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রোমান সিনেট। আর বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির নামকরণ করা হয় রোমানদের দেবতা জানুসের নামে। লাতিন শব্দ জানুস, অর্থ দরজা। এই দরজা মানেই ইংরেজি নতুন বছরের আগমন, ইংরেজি নতুন বছরের শুরু। তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে জানুয়ারি মাসের নাম হওয়ায় জুলিয়াস ভাবলেন নতুন বছরের ফটক হওয়া উচিত জানুয়ারি মাস।
সেজন্য জানুয়ারির ১ তারিখে নববর্ষ পালন শুরু হলো। আর পরে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে প্রাচীন কুইন্টিলিস মাসের নাম পাল্টে রাখা হয় জুলাই। আরেক বিখ্যাত রোমান সম্রাট অগাস্টাসের নামানুসারে সেক্সটিনিস মাসের নাম হয় অগাস্ট। যিশুখ্রিষ্টের জন্ম বছর থেকে গণনা করে ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রি ৫৩২ অব্দ থেকে সূচনা করেন খ্রিষ্টাব্দের। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের কথা। রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিদদের পরামর্শ নিয়ে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। এরপর ওই সালেই অর্থাৎ ১৫৮২ তে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১ জানুয়ারিকে আবার নতুন বছরের প্রথম দিন বানানো হয়। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরটি ছিল বৈচিত্র্যময়।
অতীত পেছনে ফেলে সামনে নতুন বছর। এখন নতুন বছর ও নতুন সূর্যের অপেক্ষায় সবাই। নতুন বছরে সকলের কাছে আমার প্রত্যাশা, আসুন পুরনো বছরের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা সব ভুলে গিয়ে নতুন বছরে নিজেকে নতুন করে গড়া তুলি। মনে রাখি, সংকল্পই আমার মধ্যে পরিবর্তন আনবে।