• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চালের দাম কমলেও খুচরা বাজারে প্রভাব নেই


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২৪, ০৯:৫৮ পিএম
চালের দাম কমলেও খুচরা বাজারে প্রভাব নেই
চালের দোকান। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হুট করেই বাজারে চালের দাম প্রতি কেজিতে ৫-৭ টাকা বেড়ে যায়। দেশে চাহিদা তুলনায় চালের মজুত থাকার দাবি করা হলেও বাজারে সংকট তৈরি করে এ বাড়তি দাম করা হয়েছে বলে ভাষ্য সচেতন মহলের। তবে ঘোষণা ছাড়াই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নড়েচড়ে বসে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, “দাম যেভাবে চার দিনে বাড়িয়েছেন, সেভাবে চার দিনে কমাবেন।”

জানা গেছে, খাদ্যমন্ত্রীর চাপের মুখে দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখনো খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, ঢাকার বাইরে চালের মোকামে দাম কমেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাইকারি দোকান মেসার্স মাস্টার এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা জালাল উদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “দুই দিন আগে আমার দোকানে যে মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬৮ টাকা, সেটি আজ ৬৭ টাকায় বিক্রি করছি। যে নাজিরশাইল ৬৫ ছিল সেটি ৬৩ টাকা, আর যে স্বর্ণা ৪৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেটি ৪৭ টাকায় নেমেছে।”

টিসিবির বাজারদরের হিসাব বলছে, শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল খুচরায় মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৬২ থেকে ৭৫ টাকায়। গত সপ্তাহে তা ছিল ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। পাইজাম ও লতার মতো মাঝারি চালের দাম গত সপ্তাহে ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, সেটি এখন ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। স্বর্ণা ও চায়না ইরির দাম এখন ৫০ থেকে ৫২ টাকা, গত সপ্তাহে তা ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারিতে চালের দাম প্রতি কেজি ২-৩ টাকা কমলেও এর কোনো প্রভাব নেই খুচরা বাজারে। গত সপ্তাহের মতোই প্রতি কেজিতে ৫-৭ টাকা বেশি বিক্রি করা হচ্ছে। বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করলেও দাম বাড়ার কারণ জানেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা।

তাদের ভাষ্য, আগের বেশি দামে কেনা চাল এখন কমে বিক্রি সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে অভিযান চালানো হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যে খুচরা বাজারেও দাম কমার আশা করছেন সবাই।

উত্তরার শহিদুল ইসলাম নামের এক খুচরা চাল বিক্রেতা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “খবরে দেখলাম বড় বড় ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আমরা সেই কম দামে চাল এখনো হাতে পাইনি। হুট করেই চালের দাম বাড়ার কারণ কী আমরা বুঝতে পারলাম না। তবে চালের মোকামে শুনেছি বাজারে নাকি চাল সংকট।”

শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, “কোনো জিনিসের দাম আমাদের মতো সাধারণ ব্যবসায়ীদের ধরতে ভোক্তা অধিকারের ম্যাজিস্ট্রেটরা আসে। অথচ পণ্যের দাম বাড়ানোর পেছনে যে আমাদের হাত থাকে না, সেটা তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা যে হাতিয়ে নিচ্ছে সেগুলোকে কিছু করতে পারে না। দাম বাড়লেও আমরা সাধারণ মানুষের কাছে দোষী, কমলেও বলে ধান্দা শুরু হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এমন পরিস্থিতি আমরা কোথায় যাব?।”

চালের দামসহ সবকিছুর দামই বাড়তি চলছে বাজারে। এসব নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান ক্রেতারা। কারওয়ান বাজারে চাল কিনতে এসে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনামুল হক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বাজারে গেলেই এ জিনিসের দাম বেশি, সে জিনিসের দাম বেশি। শুধু দাম বাড়েই, কমে না। যদি চালে ১০ টাকা বাড়ে, সরকারের কাছে নানা অজুহাত দেখিয়ে ২ টাকা কমায় ব্যবসায়ীরা। অথচ সাধারণ মানুষ বেশি দামে চাল কিনতে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে কি না সেটা কেউ ভাবে না।”

এনামুল হক আরও বলেন, “নিত্যপণ্যের বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দামই এখন সাধারণের নাগালের বাহিরে। অথচ এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। সংসার চালাতে কী পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে, এটা আমরাই ভালো জানি। মাস শেষে যে টাকা বেতন পাই। তা দিয়ে সংসার চলে না। আরও মাস শেষে মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। আমরা সচেতন মহল হয়ে সরকারের কাছে দাবি, বাজার যেন সবসময় স্থিতিশীল থাকে। আমরা সাধারণ মানুষ যেন পরিবার নিয়ে দু’বেলা ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারি।”

অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে প্রায় সারা বছরই অস্থির থাকে নিত্যপণ্যের বাজার। কখনো চালের দাম বাড়ে, কখনোবা আটা-ময়দার। বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর জোর তৎপর দেখা গেলেও বাজারে খুব বেশি একটা সুফল আসে না। তবে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ওপর। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম যেন জনসাধারণের হাতের নাগালে আসে সেই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যেকোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি কমানোর তাগিদ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। আর প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা পেয়ে তৎপর হয়েছে উঠেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো। রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজারে লাগাম টানতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন।

মন্ত্রীসভায় দায়িত্ব নেওয়ার পরই নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। আর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, “দেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না।”

অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও এতে স্বস্তির কিছু নেই। আশঙ্কার বিষয় হলো, চালের দাম কোনো কারণ ছাড়াই বাড়তে শুরু করেছে। আর চাল মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। সামনে আসন্ন রোজা। এই সময়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে, বিশেষ করে আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। রমজানকে কেন্দ্র করে এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সাসেম) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “বাজার মনিটরিং ছাড়াও এখন অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো দ্রুত শুরু করা উচিত। এখানে মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব আছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের একটা সংকট ছিল। এখন নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিয়েছে। তারা কতটা পারেন তা দেখার বিষয়।”

Link copied!