• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

যে কারণে তপ্ত দ্বীপে পরিণত হচ্ছে ঢাকা


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: মে ১, ২০২৪, ০৯:৫৫ পিএম
যে কারণে তপ্ত দ্বীপে পরিণত হচ্ছে ঢাকা

রাজধানীসহ সারা দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। গরমে গরমে অতিষ্ঠ নগরবাসী। তবে রাজধানীর স্থান ভেদে তাপমাত্রার পার্থক্য রয়েছে। গাছ কাটাসহ নানা কারণে রাজধানীর কয়েকটি স্থানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এসব এলাকাকে বলছেন ‘হিট আইল্যান্ড’ অথবা ‘তপ্ত দ্বীপ’।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে ঢাকা শহরের তাপদাহ নিয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অন হিট ওয়েভ ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক গবেষণা পরিচালনা করে। এতে ঢাকার ২৫টি স্থানকে ‘তপ্ত দ্বীপ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে বাড্ডা, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাবো, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা, জুরাইন, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, উত্তরা, কামারপাড়া, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, আদাবর, ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া ও মহাখালী এলাকা।

এসব এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় (উত্তরা, বসুন্ধরা) বর্তমানে তপ্ত দ্বীপ উপাদানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

কোনো এলাকায় সবুজ এলাকা কম থাকলে এবং কংক্রিটের পরিমাণ বেশি থাকলে তাপমাত্রাও বেশি থাকে। অধিক তাপমাত্রার এই এলাকাগুলোই ‍‍`হিট আইল্যান্ড‍‍` হয়ে ওঠে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এলাকার তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এসব এলাকায় প্রচুর গাছপালা ও খোলা জায়গা থাকায় তেমন তাপ অনুভূত হয় না। কিন্তু মতিঝিল, কারওয়ান বাজার ও মগবাজার এলাকায় গাছপালা কম থাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি।

জানতে চাইলে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “তাপ বাড়ার যত কারণ, সবই ঢাকায় আছে। কিন্তু তাপ কমানোর যেসব উপাদান আছে, তার কোনোটিই নেই। ধারণক্ষমতার চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ বাস করছে এ শহরে। ৫ থেকে ৬ লাখ যানবাহনের ক্যাপাসিটি থাকলেও চলছে ১৬ লাখের বেশি। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ভূমি শীতল হচ্ছে না। যার কারণে মাটিও তাপ শোষণ করতে পারছে না।”

তিনি আরও বলেন, “দিনের বেলায় যে তাপমাত্রা থাকে, রাতের বেলা তা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি রাতের ঢাকাও উত্তপ্ত থাকছে। এগুলো হচ্ছে আরবান হিট আইল্যান্ড প্রক্রিয়ার কারণে।”

নগরবিদরা বলেন, একটি আদর্শ শহরের জন্য ১৫ শতাংশ সবুজ ভূমি থাকা প্রয়োজন। আর জলাভূমি থাকার নিয়ম কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। বর্তমানে ঢাকায় সবুজ ভূমি রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। অন্যদিকে জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২.৯ শতাংশে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকায় ১২ হাজার ৫০০ মানুষের জন্য ২ একর মাঠ এবং ১ একর পার্ক থাকার কথা। সেখানে আমরা দেখছি ৩৭ হাজার মানুষের জন্য ১ একর পার্ক রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের ১৯৮৫ সালের রেকর্ড অনুযায়ী ২ হাজার পুকুর থাকার কথা। কিন্তু তা নেই। পুকুর থাকলে সেখানে পানি থাকবে এবং খোলা জায়গায় গাছপালা থাকলে সেটা সূর্যরশ্মি শোষণ করবে। হয় পুকুর ভরাট করে বাড়ি বানানো হয়েছে বা বাজার করা হয়েছে অথবা অন্যকিছু করা হয়েছে। এক কথায় কংক্রিট করা হয়েছে। কংক্রিট সূর্যের তাপ শোষণ করবে না, বরং সূর্যের আলো সেখানে প্রতিফলিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ঘুরপাক খাবে।”

তিনি আরও বলেন, “২০২১ সালে ঢাকার ২৫টি স্থানকে ‘হিট আইল্যান্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় তাপমাত্রা বেশি, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ গড়ে উঠেছে। সবুজ প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে সূর্যের তাপ শোষণ করার উপাদান নষ্ট হয়েছে।”

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার এক তথ্য বলছে, পৃথিবীর উষ্ণতম বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারে ২০২৪ সাল। জাতিসংঘের আবহাওয়া সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ১ দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সেইসঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ‘এল নিনো’র প্রভাবে বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন পরিবেশ ও আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তনে অসঙ্গতি দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে।

তথ্য বলছে, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সেই ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) তপ্ত দ্বীপ বা আরবান হিট আইল্যান্ড সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগর এলাকার তাপমাত্রা স্বভাবতই অত্যধিক হয়ে থাকে। কারণ নগর এলাকায় স্থাপিত ইট-সিমেন্ট-কাচের অবকাঠামোসমূহ (রাস্তা, সুউচ্চ ভবন) সূর্য থেকে আগত আলোকরশ্মি শোষণ করে। এর ফলে এসব অবকাঠামোর পৃষ্ঠতল অত্যধিক তাপ ধারণ করে থাকে। তাছাড়া শিল্প কার্যকলাপ, গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমেও নগর এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে যায়।

নগরবিদরা মনে করেন, নব্বইয়ের দশকের পর দেশে অপরিকল্পিত, মানববিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশ বৈরি কার্যক্রমের মাধ্যমে দ্রুত নগরায়ণের কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “বর্তমানে শহরগুলোয় তাপমাত্রা অনুভবের তীব্রতা বেড়েছে, অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চেয়ে অনুভবের মাত্রা বেড়েছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে মানুষের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে। ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে অর্ধবিকলাঙ্গ একটি প্রজন্ম।”

Link copied!