• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

করোনাকালে কতটা সুরক্ষিত গণমাধ্যমকর্মীরা?


শাহাদাত হোসেন তৌহিদ
প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১, ০৯:১৪ এএম
করোনাকালে কতটা সুরক্ষিত গণমাধ্যমকর্মীরা?

দুর্যোগকালীন যারা সম্মুখযোদ্ধা, তাদের মধ্যে চিকিৎসকদের পরেই গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থান। অপর দিকে রাষ্ট্রের ফোর্থ এস্টেট বা চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়েছে সাংবাদিকতাকে। আখ্যায়িত করা হয়েছে মহান পেশা হিসেবে। রাষ্ট্র ও সমাজের যেকোনো দুর্যোগে সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে।

চলমান করোনা মহামারিতে যখন সবাই ঘরবন্দি, ঠিক এ সময় বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যকর্মীদের আগ্রহের কোনো কমতি দেখা যায়নি। মহামারির শুরু থেকে অন্যান্য জরুরি সেবার পাশাপাশি গণমাধ্যকর্মীরাও চেষ্টা করছেন তাদের পেশাদারির সর্বোচ্চ ব্যবহার দেখাতে। নানা ধরনের বাধা উপেক্ষা করে সঠিক খবরটি তুলে আনার জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে।

কিন্তু সে হিসেবে সাংবাদিকদের সুরক্ষা কতটুকু মিলেছে—এটিই এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ ‘আমাদের গণমাধ্যম আমাদের অধিকার’-এর হিসাব বলছে, সারা দেশে এখন পর্যন্ত চার হাজারের বেশি গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারানোসহ নানা ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এর মধ্যে সরাসরি চাকরি হারানো বা ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন ১ হাজারের বেশি সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমকর্মী। তাদের হিসাবে, এ পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এক হাজারের কাছাকাছি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

এর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের। নির্যাতনের শিকার থেকেও বাদ যাননি সাংবাদিকরা। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি প্রকাশ করার অভিযোগে দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন করে মামলা দিয়েই চুপ থাকেননি, তারাই ঘটনার তদন্ত করছে। ব্রিটিশ আমলের রচিত ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩’-এর আইনে মামলা করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে বরাদ্দের বিপরীতে রোগীর খাবার পরিবেশনে অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় তিনজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজ।

রাষ্ট্রের কাছে সাংবাদিকতা এখন ‘তুচ্ছ’ উল্লেখ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এখন যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে সর্বহারা, আমজনতা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তাদের সুরক্ষা দেওয়াই তো কঠিন, এমনকি যারা সম্মুখসারির চিকিৎসক, তাদেরও সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন। কারণ, আমাদের রাষ্ট্র অনেক দিন থেকেই কতিপয়ের জন্য, তেলা মাথায় তেল দেওয়া। যারা বড় বড় মানুষ, যাদের অনেক বিত্ত আছে, যাদের অনেক ক্ষমতা আছে, তাদের অনুকূলে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সঞ্চয়। আমাদের বাজেটের প্রণোদনার সিংহভাগই তো তারাই পায়। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিটাই হলো এ রকম, সেখানে সাংবাদিক তো তুচ্ছ। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে যে কথাটা চালু আছে, সেটা এখন আর চালু নেই।” 

এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বিভাজনকে দায়ী করে কামরুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, “গণমাধ্যমকর্মীদের বিভাজনের ফলে রাষ্ট্র আমাদের যে সম্মান দিত, সেটা আর এখন নেই। ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের করোনাকালে যে আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ার কথা ছিল, সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাওয়ার কথা ছিল, তা থেকে আমরা বঞ্চিত।”

সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক তুষার আবদুল্লাহ বলেন, “প্রথম যখন লকডাউন শুরু হয়, তখন অফিসগুলো মাস্ক দেওয়া, অফিসে কম লোক থাকা, ডিউটি ভাগ করে দেওয়া অর্থাৎ নানা রকম সুরক্ষা ছিল। সাংবাদিক সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে তৎপর ছিল। এখন আর সেগুলোর বালাই নেই। ডাক্তারের পরে তো সাংবাদিকরাই ফ্রন্টলাইনার, সে হিসেবে সাংবাদিকরা সুরক্ষা পাচ্ছেন না। তা ছাড়া সাংবাদিকরাও এতটা সচেতন থাকছেন না বা থাকার জন্য যে ব্যবস্থা বা তাগিদ, সেটাও নেই।”

প্রণোদনার বিষয়ে তুষার আবদুল্লাহ বলেন, “প্রণোদনা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন অনেক ঘোরাঘুরি করেছে, সেভাবে তো তেমন কিছু হয়নি। আসলে কাকে দেবে, এখন এত টেলিভিশন, পত্রিকা, অনলাইন সবাই তো ফ্রন্টলাইনে আছে। সবকিছু মিলিয়ে তো আমরা গোছানো না। যেহেতু আমরা গোছোনো না, সরকারও এখন কাকে রেখে কাকে দেবে? জেলা পর্যায়ে অনলাইন আছে। জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকরা কাজ করছেন, তারা কেউ নিবন্ধিত না। বলতে পারেন প্রেসক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটির। প্রেসক্লাবের বা রিপোর্টার্স ইউনিটির সবাই কি সক্রিয় সাংবাদিক? তা না। রিপোর্টার্স ইউনিটির মেম্বার হিসেবে আমি দিয়ে গেলাম কিন্তু যে মাঠে আছে, সে তো মেম্বারশিপই পায়নি। রিপোর্টার্স ইউনিটি তো সবাইকে মেম্বারশিপই দেয়নি। তারা তো পাচ্ছে না। এই জায়গাগুলো দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে।”

সাংবাদিকদের প্রতি রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব আছে উল্লেখ করে সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সাংবাদিকরা শুধু সম্মুখসারির যোদ্ধা নন, অগ্রভাগের সৈনিক। সম্মুখসারিতে যে যুদ্ধ শুরু হবে, তারও আগে আমরা ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের অবস্থান দেখতে পাই। দুর্যোগপূর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যখন সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করেন, তখন রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব থাকে। এ কারণে যে, সাংবাদিকরা তো আর সরকারের বিরুদ্ধে খবর তুলতে যান না। দুর্যোগপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যখন সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করেন, তখন তারা কিন্তু সরকারকে সহযোগিতা করেন। কারণ, সরকার তো নীতিনির্ধারণী-প্রণোদনা নিয়ে বসে আছে, কিন্তু কাকে দেবে, কোথায় দিতে হবে, এসব তথ্য যদি তারা গণমাধ্যমে না পায়, তাহলে প্রণোদনা-নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাবে না।”

গণমাধ্যমকে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে মনজুরুল আহসান বুলবুল আরও বলেন, “আমরা শুরু থেকেই বলছিলাম যে গোটা গণমাধ্যমটাকে একটা শিল্প হিসেবে দেখতে হবে। এটাকে কমপ্লিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্টের চিন্তা থেকে দেখতে হবে। সেটা কীভাবে, যেমন ধরেন গার্মেন্টসের জন্য সরকার যখন প্রণোদনা দেয়, তখন স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া হবে মালিকদের। মালিকরা যে টাকাটা নেবেন, সেটা শুধু শ্রমিকদের বেতনের জন্য নিতে হবে শুধু। সরকার যদি এ রকম করে যে, গণমাধ্যমের মালিকরা এ দুর্যোগ মুহূর্তে কাউকে ছাঁটাই করতে পারবেন না, কারও বেতন বন্ধ করতে পারবেন না, সরকার বলবে যে তোমাকে আমরা স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি একটা ঋণ দেব। এটি শুধু সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হবে। আর হকার বা ক্যাবল অপারেটর যারা তাদের যদি সরকার রেশনের সুবিধা দেয়, অন্য যেসব সামাজিক সুরক্ষা আছে, সেগুলো আনা যেতে পারে। সুতরাং এই ইন্ডাস্ট্রি যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে শুধু রিপোর্টারকে বা ক্যামেরাম্যান দিয়ে নয়, ভেতরে যারা কাজ করে সাব-এডিটর, ভিডিও এডিটও বা বার্তাকক্ষ সবার কথা ভাবতে হবে।”

একই সঙ্গে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও সাংবাদিকদের নিজের সুরক্ষা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

Link copied!