• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ছাত্রলীগের অপকর্মে সর্বনাশ আ.লীগের


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৩, ১০:০৪ পিএম
ছাত্রলীগের অপকর্মে সর্বনাশ আ.লীগের

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী হেনস্তাসহ প্রায় সব ধরনের অপকর্মে আসছে ছাত্রলীগের নাম। কমিটিতে ঢুকতে সব সময় মরিয়া অপকর্মে জড়িতদের একটি বড় অংশ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সমস্যা সমাধান কিংবা অধিকার আদায়ে ছাত্রলীগের ভূমিকা তেমন দেখা যায় না। বরং ছাত্রলীগের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে দেখা যায়। নানা গ্রুপে বিভক্ত ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যেও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে হেনস্তা, নগ্ন করে ভিডিও ধারণ ও তার বন্ধুকে মারধরের আলোচিত ঘটনায়ও জড়িতদের প্রায় সবাই ছিল ছাত্রলীগের কর্মী কিংবা কোনো নেতার অনুগত। ছাত্রলীগের অপকর্ম ক্ষমতাসীনদের মাথা নিচু করে দিয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, “ছাত্রলীগের গৌরবের ইতিহাস যেমন আমাদের মাথা উঁচু করে, তেমনি ছাত্রলীগের সাম্প্রতিককালের কিছু অপকর্ম আমাদের মাথা নিচু করে দিয়েছে। ‘কিছু হাইব্রিড ও ফরমালিন’ ঢুকে ছাত্রলীগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।”

টেন্ডারবাজি-অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়

আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের মুখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অবস্থান করতে পারছে না। ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় আদর্শের চর্চা বা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলা এসব মৌলিক বিষয়ে ছাত্রলীগকে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। বরং সংগঠনটিতে ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, আর্থিক স্বার্থের বিষয় প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। এমন নানা রকম স্বার্থের কারণে সংগঠনটিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভিন্ন উপদল বা দলাদলিতে মারামারির ঘটনা প্রায়ই জড়িয়ে পড়ে সংগঠনটির কতিপয় নেতাকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নয়নকাজের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ তো আছেই। ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এ ধরনের অপরাধের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

ঢাবিতে দুই ছাত্রলীগ নেতা আটক

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালীমন্দির এলাকায় বইমেলায় আসা দর্শনার্থীর কাছ থেকে চাঁদাবাজির সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (১৬ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় তাদের আটক করা হয়। আটক দুইজন হলেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজীব হোসেন রবিন ও মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোহাইমেনুল ইসলাম ইমন।

ছাত্র অধিকার পরিষদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনটির পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল এগারোটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এ হামলা হয়।

হাইকোর্টের আদেশে দুই নেত্রী ক্যাম্পাস ছাড়লেন

সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোচিত কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রী নির্যাতনে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সানজিদা চৌধুরী ও তাবাসসুম ইসলাম ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে তারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শাহাদাত হোসেন। রোববার রাতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এই ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই ছাত্রী বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।

শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ

একজন শিক্ষিকাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটে ৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের ওমর গণি কলেজে ওই শিক্ষিকা একটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছিলেন। ওই শ্রেণিকক্ষেই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক একজন নেতা শিক্ষিকাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনার কয়েক দিন আগে ৩০ জানুয়ারি একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র হলের সহকারী প্রক্টর অমিত দত্তকে লাঞ্ছিত করেছেন ছাত্রলীগের একদল নেতা–কর্মী। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মাসে তিনজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হন ছাত্রলীগের হাতে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুটি উপদলের সংঘর্ষ ঠেকাতে গিয়ে একজন শিক্ষক আহত হন গত ৬ জানুয়ারি। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়—এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের উপদলীয় সংঘর্ষ এবং এক পক্ষের সমর্থকদের আরেক পক্ষের মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পেছনে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং হলের সিটের দখলসহ নানা বিষয় রয়েছে।

কয়েক দিন আগে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ এলাকায় একটি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চাঁদা না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগে স্থানীয় ছাত্রলীগের একজন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

অতীতের ঘটনা এখনো আলোচনায়

বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর। এ হত্যার ঘটনার দুই বছর পর ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার নিম্ন আদালত ছাত্রলীগের ২০ জন নেতার মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন সাজা দেন। গত এক বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ১৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই গত বছরের ১৭ জুলাই একজন সাধারণ ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন করেছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, আশির দশকের ছাত্রলীগ আর বর্তমান ছাত্রলীগ এক নয়। তিনি বলেন, তাঁদের সময় ছাত্রলীগকে নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তেমন অভিযোগ ছিল না। এখন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা অর্থের লোভে আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েছেন।

একসময়ের ডাকসাইটের ছাত্রনেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। এখন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব সংগঠনের সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখবে।

এ বিষয়ে ছাত্র সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ক্যাম্পাসগুলোতে সুষ্ঠু একাডেমিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ছাত্রলীগ কাজ করছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের সমস্যা রয়েছে। এই র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা প্রয়োজন।

সাদ্দাম হোসেন আরও বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থী ও মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে দিন-বদলের রাজনীতি করছেন। কিন্তু যেসব নেতিবাচক ঘটনা ঘটে, তা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে ঘটে। এটি সংগঠনের বিষয় নয়। কেউ অপরাধ করলে আইন ও নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, দেশে জাতীয় রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতির কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। সে কারণে নানা অনাচার হচ্ছে। গণতন্ত্রের চর্চা না হলে ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আসবে না।

Link copied!