আজ ঋতুরাজ বসন্তের শেষ দিন ৩০ চৈত্র। আজ চৈত্রসংক্রান্তি। আবহমান বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্রসংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। মনে করা হয়, চৈত্রসংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পয়লা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন।
আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) পয়লা বৈশাখ, নতুন বাংলা বর্ষ ১৪২৯। এর আগের দুই বছর করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পয়লা বৈশাখসহ সব ধরনের জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠানও ছিল না। তবে এবার অনেকটা করোনামুক্ত পরিবেশেই চৈত্রসংক্রান্তি এবং বাংলা নববর্ষ পালনে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে গত দুই বছর নববর্ষের প্রথম প্রহরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। এবার ছায়ানটের অনুষ্ঠানসহ বর্ণিল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ।
জনশ্রুতি আছে, চৈত্র মাসে স্বামী, সংসার, কৃষি, ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। জিয়ল মাছ (পানিতে জিইয়ে রাখা যায় এমন মাছ) যেমন কৈ শিং মাগুরের ঝোল করে খেতেন তারা। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতো খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক খেতে বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতো, সারা বছরের কৃষি কর্ম ঠিক ছিল। ফলে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তারা।
গ্রামের নারীরা এ সময় সাজগোছ করেন ঘরদোর। মাটির ঘর লেপন করে ঝকঝকে করেন। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে রাখাল। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেওয়া হয়। ঘরে ঘরে চলে বিশেষ রান্না। উন্নত মানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নকশি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। দিনভর চলে আপ্যায়ন। গ্রামের গৃহস্থরা এ দিন নতুন জামা কাপড় পরে একে অন্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। একসময় এমনই ছিল চৈত্রসংক্রান্তির ধরন।
চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।
চৈত্রসংক্রান্তির দিনে শাকান্ন পালনের রীতি দেখা যায়। এদিন সকাল বেলাতেই বাড়ির চারপাশের জলা, জংলা, ঝোপঝাড় থেকে শাক তুলে আনতো বাড়ির বউ-ঝিরা। মজার ব্যাপার হলো, এই শাক কিন্তু আবাদি বা চাষ করা হলে হবেনা। হতে হবে অনাবাদী। এমন চৌদ্দো পদের শাক দিয়েই সেদিন দুপুরের আহার হতো। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে এই আহার ছাড়া বাড়িতে কোনো মাছ মাংসের পদ রান্না হতো না। আজও বাংলার কোনো কোনো গ্রামে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে শাকান্ন উৎসব পালিত হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লোকজ পূজার চল আছে। চৈত্রসংক্রান্তি ও এর আগের কয়েকদিন মিলে পালিত হতো চড়ক পূজা। সন্তান প্রাপ্তি, দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ ও মনের বাসনা পূরণের আশায় পূজা করা হতো। পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই ব্রত এবং সংযম পালন করতেন ভক্তরা। এরপর একজনকে হনুমানের মতো লম্বা লেজ এবং মাথায় লালরঙের ফুল দিয়ে সাজানো হতো। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে চড়ক পূজা পালন করা হয়। প্রথম ভাগকে বলা হয় গিরি সন্ন্যাস, দ্বিতীয়ভাগে বাবর সন্ন্যাস, তৃতীয় ভাগে নীল পূজা, চতুর্থ ভাগে হাজরা পূজা ও দেবতার ভর। শেষভাগে চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে ভক্তি প্রদর্শনের জন্য ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার ওপর ঝাঁপ দিয়ে মাথা নিচে রেখে ঝুলে থাকেন। এরপর বাণ সন্ন্যাস, বেত্র সন্ন্যাস ও বড়শি সন্ন্যাস পালন করে এই পূজা শেষ হয়। একসময় বাংলার প্রায় সকল অঞ্চলে পালিত হতো চড়ক পূজা। চড়ক পূজা উপলক্ষে বেশির ভাগ গ্রামে আজও বসে সপ্তাহব্যাপী মেলা।
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাঙালি ছাড়াও উৎযাপন করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রধান উৎসব বৈসাবি পালিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের দিনে। বৈসাবির ‘বৈ’ এসেছে ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ থেকে, ‘সা’ এসেছে মারমাদের ‘`সাংগ্রাই’ থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘বিজু’ থেকে।