• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চলচ্চিত্রশিল্পকে জাতীয়করণে জহির রায়হানের প্রেষণা


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২৩, ১০:২৫ এএম
চলচ্চিত্রশিল্পকে জাতীয়করণে জহির রায়হানের প্রেষণা
চলচ্চিত্র শিল্পকে জাতীয়করণে জহির রায়হানের প্রেষণা

স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় অনেক সময় রাজনৈতিক আন্দোলনের উৎস হয়ে উঠতে পারে। এমনকি সেটা বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদেও রূপ নিতে পারে। উপনিবেশ-উত্তর নতুন রাষ্ট্রে এমন বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদের দেখা মেলে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নব্য গঠিত রাষ্ট্রে সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদের মীমাংসা হয়ে যায়, রাষ্ট্রের ভেতর অঞ্চল পৃথক্‌করণের ভেতর দিয়ে। এদিক থেকে বাংলাদেশ জন্মের ঘটনাটি অপূর্ব। দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ শাসন বিদায়ের পর, পাকিস্তান গঠনের দুই যুগের ভেতর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের প্রতিবাদে, ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের নতুন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন হওয়ার ঘটনাকে বলা যায় অভূতপূর্ব। এ ঘটনাকে ইতিহাসের বিশাল ব্যতিক্রম বলে আখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ পণ্ডিত জন ব্রুয়িলি। ‘ন্যাশনালিজম অ্যান্ড দ্য স্টেট’ বইয়ে ব্রুয়িলি বলছেন, “নয়া গঠিত জাতিরাষ্ট্রে কর্তৃত্ব বিস্তারের প্রচেষ্টা এবং সেই রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে চ্যালেঞ্জ জানানো, দুটি ঘটনাকেই বলা যায় একই সংঘাতের দুই পিঠ। তারপরও, সাধারণভাবে বিশ্লেষণের জন্য দুটি ঘটনাকে আলাদা করে দেখার প্রয়োজন আছে। কেউ বলতে পারেন, নয়া রাষ্ট্রে আপাতদৃষ্টে রাজনীতির এই দ্বান্দ্বিক চেহারা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা মোচনেরই ফল। একদিক থেকে দেখলে এগুলো দেখা যায় দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী হয়। এর খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। তারপরও অন্যদিকে দেখা যায় এই চ্যালেঞ্জ অটুট রেখেই নয়া রাষ্ট্রগুলো টিকে থাকে, বেশি হলে ঘটনা আঞ্চলিক ভেদাভেদ পর্যন্ত গড়ায়। এই সাধারণীকরণের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের জন্মই হলো একমাত্র বিরাট ব্যতিক্রমী ঘটনা”। (ব্রুয়িলি ১৯৯৩: ২৫৭)


আর এই ব্যতিক্রমী ঘটনার প্রধান কারণ হলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব, তথা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। এখানে এক অংশের দ্বারা আরেক অংশকে শোষণ, শোষিত অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের গৌণ করে রাখা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ সবকিছুই একেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণে। আমরা এই কারণগুলোর ভেতর নজর দিতে চাই সাংস্কৃতিক দিকটিতে। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের দিকে। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র। নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভাবনার দিকে।
বাংলাদেশ যে একটি নতুন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, সেটি তৎকালের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতজনদের বুঝতে সময় লাগেনি। আর সেই কারণেই তারা যুদ্ধ চলাকালেই চলচ্চিত্রশিল্পকে জাতীয়করণের পরিকল্পনা করেছিলেন। বলা বাহুল্য হবে না, এই পরিকল্পনার পেছনে সাম্যবাদী বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার কল্পনা ছিল। এর সাক্ষ্য পাওয়া যায় নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমামের লেখায়। তাঁরা যুদ্ধ চলাকালে গঠন করেছিলেন ‘বাঙলা দেশ চলচ্চিত্র শিল্প ও কুশলী সমিতি’। সমিতির অন্যতম সদস্য ও সংগঠক সৈয়দ হাসান ইমামের লিখছেন, “সমিতির পক্ষ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও আমি মিলে সমাগত স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে জাতীয়করণের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিলাম। আমাদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবে এবং সেখানে চলচ্চিত্রকে সমাজ বদলের হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই পরিকল্পনাটি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।” (ইমাম ২০২১: ১১)


বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে সব অন্যায় জুলুমের জবাব দিতে দিতে যে রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছিল, সেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী হিসেবে জহির রায়হান, আলমগীর কবির, সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখরা ভাবছেন চলচ্চিত্রকে সত্যিকারের গণমানুষের করে তুলতে হবে। এবং সেটা জাতীয়করণের ভেতর দিয়েই করা সম্ভব। তাঁদের চিন্তায় তখন যৌথ খামার। স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এই চিন্তায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রভাব ছিল ব্যাপক। অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রের যে অগ্রগতি হয়েছিল, সেটিই আন্দোলিত করেছিল পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্রশিল্পীদের। বিশেষ করে জহির রায়হানকে। 


১৯৬৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে তিনি লিখেছিলেন, “অক্টোবর বিপ্লব এবং সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটিয়েছে। ...অক্টোবর বিপ্লবের সঙ্গে সিনেমার জন্মের কোনো সম্পর্ক নেই। দুটোই পৃথক ঘটনা। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লব যদি না হতো, সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম যদি না হতো, তাহলে সিনেমা চারুকলা (Fine art) হিসেবে আদৌ স্বীকৃতি পেত কি না, সন্দেহ। শুধু তা-ই নয়, এই নতুন কলামাধ্যমটির মধ্যে যে এত বড় সৃষ্টিশক্তি লুকিয়ে আছে, তা-ও হয়তো আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম না।”  (রায়হান ২০১৭: ৫৯৯-৬০০) 


রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের যে অঙ্গীকার সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল, জহির রায়হানেরও প্রত্যাশা ছিল নতুন মানচিত্র পেতে যাওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে শোষণহীন ও শ্রেণিহীন। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে মুনাফাকেন্দ্রিক বুর্জোয়া সিনেমার বদলে এমন সিনেমা নির্মিত হবে, যেখানে সস্তা চিত্তবিনোদন থাকবে না, বাজারি যৌনতা ও উগ্র অপরাধকে পুঁজি করা হবে না। জহির রায়হান মনে করতেন “বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় আর্টের সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব নয়। ফিল্ম আর্টের পক্ষে এ উক্তি সবচেয়ে বেশি করে প্রযোজ্য। কারণ, চলচ্চিত্র হচ্ছে একদিকে আর্ট অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রি, দুটোই।” (রায়হান ২০১৭: ৬০০)


দুই শিল্পের রূপ চলচ্চিত্রে বিদ্যমান বলেই জহির রায়হান একে কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে পরিচালনার কথা ভেবেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ কবিতা বা সংগীত রচনা নয়। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থের। তাই রাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। আগেই বলেছি, সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রনীতির ওপর তাঁর আস্থা ছিল। কেমন ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্রশিল্পের জাতীয়করণ নীতি? রুশ বিপ্লবের দুই বছরের মাথায় ১৯১৯ সালে জাতীয়করণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চলচ্চিত্রশিল্পকেও কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এতে কিছুটা সমস্যা হয় অবশ্য। অনেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের কাঁচা মাল বাজার থেকে উধাও করে দেন। তবে তাতে বিপ্লবী সরকার হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা ১৯২০ সালে চলচ্চিত্রকর্মীদের সরকারি ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরের বছরই, ১৯২১ সালে ঘোষণা করে নয়া অর্থনৈতিক নীতি, আর এতে অনেক মজুদকৃত ফিল্মের হদিস মিলতে থাকে, শুধু তা-ই নয়, ছবি পরিবেশন ও যন্ত্রপাতির ব্যবহারের দিক থেকেও অনেক সুবিধা পেতে শুরু করেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। বিদেশ থেকে ছবি আমদানিসহ সমবায়ভিত্তিক ফিল্ম কোম্পানি গড়ে ওঠে। তবে এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও স্থানীয় ছবির সংখ্যা বাড়েনি, তাই চলচ্চিত্রশিল্পেরও সেই অর্থে প্রসার ঘটেনি। (থম্পসন ২০০৫: ২২-২৩) তাতে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব কমে যায়নি রুশ বুদ্ধিজীবীদের কাছে, বরং বেড়েছে।


১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষামন্ত্রী আনাতোলি লুনাচারস্কিকে দেশটির নেতা ভ্লাদিমির লেনিন বলেছিলেন, “আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমাদের কাছে চলচ্চিত্রই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পরূপ।” লেনিনের এই কথা কেবল কথার কথা যে ছিল না, তার প্রমাণ মেলে যখন ‘অল ইউনিয়ন স্টেট ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফি বা সংক্ষেপে ‘ভিজিআইকে’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান লেনিনের সক্রিয় উদ্যোগে সৃষ্টি হয়। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র কেন্দ্র। 


বিপ্লোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় জাতীয়করণ ও পৃষ্ঠপোষকতার ফলে চলচ্চিত্র কারখানার উপকারের পাশাপাশি অন্য আরেকটি উন্নয়ন ঘটেছিল: তাদের সার্বিক চলচ্চিত্রচর্চার ফলে দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের জায়গা থেকে চলচ্চিত্র নতুন এক তাত্ত্বিক জায়গায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এর ফল পরবর্তীকালে ভোগ করেছে গোটা দুনিয়ার চলচ্চিত্রশিল্প। এবং সেই সময়ের কুশীলবদের তাই প্রশংসা করতে ভুলে যাননি আমাদের জহির রায়হানও। তিনি বলছেন, “ধনতন্ত্রের দেশ আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক ডি ডব্লু গ্রিফিথের অর্থেক সত্য, অর্ধেক জীবন, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক আর্ট তাই পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্রের সন্তান, সোভিয়েত পরিচালক সার্জি আইজেনস্টাইন, পুদোভকীন আর ডোভজেঙ্কোর হাতে এসে সম্পূর্ণ সত্য, সম্পূর্ণ জীবন, সম্পূর্ণ মানুষ ও পরিপূর্ণ আর্টের মর্যাদা পেয়েছে।” (রায়হান ২০১৭: ৬০১)


জহির রায়হান তখনই বুঝতে পেরেছিলেন বিপ্লব কেমন করে জনসাধারণের মনে নতুন চেতনাবোধের জন্ম দিতে পারে। আর এই চেতনাবোধের একটি স্রোত যদি চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে প্রবাহিত করা যায়, তাহলে চমৎকার সব চলচ্চিত্র হতে বাধ্য। পুরাতনকে ভেঙেচুরে, অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে, নতুন সৃষ্টি হওয়া দেশে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবি নির্মাণ হবে, নতুন দর্শন ও নবলব্ধ জীবনবোধের আলোকে সেসব ছবি মানুষ দেখবে, এটাই ছিল জহির রায়হানের স্বপ্ন। তাই যুদ্ধচলাকালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, একক ও দলগতভাবে। এর পাশাপাশি ভেবেছেন নতুন দেশে চলচ্চিত্রের রূপরেখা নিয়ে। আর সেই রূপরেখা স্পষ্টতই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার ছাপ।


১৯৭১ সালের মে মাসে কলকাতায় গঠিত হওয়া ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’র সভাপতি হন জহির রায়হান। যুদ্ধের সময় এই সমিতির পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয় ‘স্টপ জেনোসাইড’ (জহির রায়হান), ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ (জহির রায়হান), ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ (আলমগীর কবির), ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নসে’র (বাবুল চৌধুরী) মতো ছবি। এই সমিতি থেকেই একাত্তরে কলকাতায় অবস্থানরত ১৩৩টি চলচ্চিত্র পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। (বাবু ২০২১: ২৮) তো এই সমিতির পক্ষ থেকেই পরিকল্পনা করা হয়—নতুন জন্ম হতে যাওয়া দেশে চলচ্চিত্রশিল্পকে কী করে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে ঢেলে সাজানো হবে। জহির রায়হানের অন্যতম সহযোগী, চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের ১৯৭৩ সালে লেখা একটি নিবন্ধ থেকে তাঁদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়।  


আলমগীর কবির লিখছেন, “আমাদের জাতীয় মুক্তির জন্য যেসব চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং শিল্পী লড়াই করতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ছিলেন, তাঁরা স্বাধীন দেশের সিনেমাকে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বাহন (করার) কথা চিন্তা করেছিলেন। অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত প্রযোজকদের হাত থেকে সিনেমাশিল্পকে মুক্ত করে তার সমাজতন্ত্রীকরণের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। ভেজাল ও অপদার্থ জিনিশের অনুপ্রবেশ (যাতে) না ঘটে তারই জন্য এ চেষ্টা। এই পরিকল্পনায় ছিল সিনেমা তৈরি, বণ্টন ও দেখান, জাতীয়করণ করা, সিনেমার জন্য একজন মন্ত্রী নিয়োগ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এমন একটা কমিটি গঠন করা, যাঁরা বাৎসরিক প্রোডাকশন একই সঙ্গে পুরনো ও নতুন পরিচালকদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করবে। এই পরিকল্পনায় আরও ছিল যে পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশেও ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরি করা (হবে)। এই পরিকল্পনায় এ কথাও ছিল যে শিল্পের বিভিন্ন বিভাগে যাবতীয় পুরনো কর্মী ও মালিকদের মাসিক বেতন-ব্যবস্থায় নিয়োগ করা যেতে পারে।” (কবির ২০১৮: ৪৩)


এই চিন্তাগুলো নিয়ে সাজানো খসড়া নীতিমালা, একাত্তরের অক্টোবর মাসে, চলচ্চিত্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত জাতীয় পরিষদ সদস্য আবুল খায়েরের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর সেই খসড়া নীতিমালা আর আলোর মুখ দেখেনি। 


কী ছিল জাতীয়করণের নীতিমালার ভেতর? চলচ্চিত্রশিল্পের মাধ্যমে তারা চেয়েছিলেন জাতীয় সংস্কৃতিকে দেশে ও বিদেশে যথার্থভাবে তুলে ধরতে। শুধু তা-ই নয়, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতির মানসিক চরিত্র গঠন ও বিকাশের সম্ভাবনাকেও এগিয়ে রেখেছিলেন তারা। চলচ্চিত্রশিল্প যেন গুটিকয় অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও পাকিস্তানের দালালদের হাতে জিম্মি না থাকে, যেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পায়, যেন তারা তাদের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পায় এবং সর্বোপরি ভালো ছবি বানিয়ে বিদেশে রপ্তানির ভেতর দিয়ে যেন বিদেশি মুদ্রা অর্জন করা যায়, সে জন্য চলচ্চিত্রকে জাতীয়করণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন জহির রায়হান ও সহযোদ্ধারা। নয়টি ধাপে তারা ব্যাখ্যা করেন জাতীয়করণের সুফল। জাতীয়করণের প্রক্রিয়া নিয়েও পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। (বাবু ২০২১: ৪৩-৫২) কিন্তু তাদের এই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার নীতিমালা স্বভাবতই বাংলাদেশ জন্মের পর আর বাস্তবে রূপ পায় না। যদিও স্বাধীনতার অঙ্গীকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতর সাম্যবাদকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।


সৈয়দ হাসান ইমাম বলছেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময়েই জহির রায়হান, আমি ও আলমগীর কবির—আমরা তিনজন বসে একটি খসড়া করেছিলাম চলচ্চিত্রশিল্পকে সরকারীকরণ প্রসঙ্গে। এমনটি ভেবেছিলাম কেননা আমাদের স্বপ্ন ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবে। চলচ্চিত্রশিল্পকে আমরা সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যবহার করেছিল ১৯২০ দশক থেকে। সের্গেই আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন বা আন্দ্রে তারকোভস্কির যে চলচ্চিত্র-দর্শন ছিল, আমরা সেটাকে নিয়ে নবগঠিত বাংলায় কাজ করার চেষ্ট করেছিলাম।” (ইমাম ২০১৯: ১০২)


যদিও তারকোভস্কির জন্ম হয়েছিল ১৯৩২ সালে, সোভিয়েত রাশিয়াতেই, তবে পঞ্চাশ দশকের শেষ প্রান্ত থেকে সক্রিয় এই নির্মাতার চলচ্চিত্র দর্শন আইজেনস্টাইন বা পুদোভকিনের সঙ্গে ঠিক মেলানো যাবে না। তারপরও সৈয়দ হাসান ইমামের কথার যে মর্ম তা হলো, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এ দেশে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হবে এই ছিল তাদের স্বপ্ন এবং তারই আলোকে এ দেশে চলচ্চিত্র চর্চা হবে, সোভিয়েত রাশিয়ায় যেমনটা হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাদের প্রস্তাবের কথা দায়িত্বশীলদের কেউ মনেই রাখেননি।
এতে আলমগীর কবিরও সমপরিমাণ হতাশ হয়েছিলেন। তিনি লিখছেন, “দুমাসের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হল। শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা করলেন। ইতিমধ্যে উপরোক্ত পরিকল্পনার কথাও হারিয়ে গেল এবং সুন্দরভাবে বিস্মৃত হলো। এই পরিকল্পনার মুখ্য শিল্পী জহির রায়হান ভবিষ্যতে কাউকে মন্ত্রিমহলে তদারকির জন্য না রেখেই অত্যন্ত তাড়াতাড়ি নিজেকে মরতে দেওয়ার পথ পছন্দ করে নিলেন।” (কবির ২০১৮: ৪৩-৪৪)


হতাশা আর অভিমান নিয়েই কথাগুলো বলেছেন আলমগীর কবির। সৈয়দ হাসান ইমাম ও আলমগীর কবির তো তা-ও হতাশা ব্যক্ত করতে পেরেছেন, কিন্তু সেটা করার কোনো সুযোগই পাননি, চলচ্চিত্রশিল্পকে জাতীয়করণ নীতিমালা প্রস্তাবকারীদের অন্যতম ব্যক্তি জহির রায়হান। যাকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফাঁদে ফেলে খুন করা হয়েছিল। কেবল সোভিয়েত আদর্শ নয়, লাতিন আমেরিকার বৈপ্লবিক আদর্শকেও ধারণ করতেন জহির রায়হান। তার সাক্ষ্য বহন করছে গেরিলা কায়দায় নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’। তাঁর সহযোদ্ধারাও অনুপ্রাণিত ছিলেন সমাজতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিপ্লবোত্তর রুশ চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রার দ্বারা। আলমগীর কবিরের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কথা বলতে গেলে আলাদা পরিসর প্রয়োজন হবে। পরিতাপের বিষয়, জহির রায়হান ও আলমগীর কবিরের মতো এমন নিবেদিত ও রাজনৈতিক মনোভাবাপন্ন নির্মাতাকে আমরা হারিয়েছি অপঘাত ও দুর্ঘটনায়। এর পরিণামে বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্রই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, গোটা বাংলাদেশই অকালে গুরুত্বপূর্ণ দুই বুদ্ধিজীবীকে হারিয়েছে, এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার মতো নয়।

   


সহায়
১. জহির রায়হান (২০১৭), অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র, জহির রায়হান রচনা সমগ্র, ঢাকা, অনুপম প্রকাশনী।
২. আলমগীর কবির (২০১৮), সংস্কৃতি সংকট ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ ১: চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ও মধুপোক।
৩. মীর শামসুল আলম বাবু (২০২১) সম্পাদিত, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি প্রণীত: চলচ্চিত্র শিল্প জাতীয়করণ নীতিমালা ১৯৭১, ঢাকা, মধুপোক।
৪. অজয় গুপ্ত (২০০৫), রুশ চলচ্চিত্রের তিন পর্ব, শতবর্ষে চলচ্চিত্র ২য় খণ্ড: ইতিহাস ও বিবর্তন, নির্মাল্য আচার্য্য ও দিব্যেন্দু পালিত সম্পাদিত, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স।
৬. ক্রিস্টিন থম্পসন (২০০৫), গভর্নমেন্ট পলিসিস অ্যান্ড প্র্যাকট্রিক্যাল নেসেসিটিস ইন দি সোভিয়েত সিনেমা অব দ্য নাইনটিন টোয়েন্টিজ, দ্য রেড স্ক্রিন: পলিটিকস, সোসাইটি, আর্ট ইন সোভিয়েত সিনেমা, আনা লোটন সম্পাদিত, লন্ডন, রাউটলেজ।
৭. জন ব্রুয়িলি (১৯৯৩), ন্যাশনালিজম অ্যান্ড দ্য স্টেট, ম্যানচেস্টার, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস। 
  

Link copied!