• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
গল্প

নুন আনতে জীবন ফুরায়


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৩, ১১:৪৯ এএম
নুন আনতে জীবন ফুরায়

কথায় আছে, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আর নজুর নুন আনতে জীবন ফুরায়। এক বেলা খেলে দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। তবুও অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলছিলাম কাশীপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের কথা। সবাই নজু নামেই ডাকে তাকে। নজু এমন এক মানুষ, যার পকেটে টাকা নেই তো কী হয়েছে? হেঁটেই চলে যায় বাজারে। কারও তেল লাগবে। কারেও নুন। কারও পান-সুপারি। নজুকে বলামাত্রই ছুটে যায়। বাজার থেকে এসে ফিরতি টাকা বুঝিয়ে দেয়। আট আনা পয়সাও এদিক-সেদিক হয় না।

গ্রামের বিধবা জরিনাকে সাহায্য করার মতো তিন কুলে কেউ নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সংসার। অলিলের এক খণ্ড জমি আর একটা ভিটা ছাড়া কিছু নেই। তবে জরিনার শরীরের সামর্থ্য এখনো যুবতী কন্যার মতোই। যত দূর জানা যায়, বারো-চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের এক বছর পরই কোলজুড়ে আসে সকিনা। অলিল যখন মারা যায়, তখন মেয়ে সকিনার বয়স আড়াই বছর।

তীব্র শীতের সকালে বদলা খাটতে গিয়ে মৃত্যু হয় অলিলের। পাশের জমির কামলারা উপজেলা সদরে নিতে নিতেই প্রাণবায়ু উড়ে যায় তার। চিকিৎসকরা জানায়, অতিরিক্ত ঠান্ডায় স্টোক হয়েছিল অলিলের। খবরটি শোনার পর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল জরিনার। শ্বশুরশাশুড়ি-অভিভাবক ছাড়া সংসারে ছোট মেয়েটিকে নিয়ে কীভাবে কাটবে দিন।

নজুরও কাজকর্ম নেই। সব আলগা কাজ তার। সবাই বলে অলসের হাড্ডি। সেই নজু একসময় পাশে দাঁড়ায় জরিনার। জরিনার প্রথম প্রথম উসখুস হয়। গ্রামের লোকে কী বলবে? কেনইবা এগিয়ে আসে নজু। নজুর লাভ কী এতে? অবিবাহিত যুবক। কী খোঁজে বিধবা জরিনার মধ্যে? উত্তর খুঁজে পায় না জরিনা। তবে এ-ও জানে যে, মানুষ হিসেবে মন্দ নয় নজু। কখনো খারাপ চোখে তাকায় না। কোনো অজুহাতে বাজে আবদারও করে না। মাঝে মাঝে বাজার-সদায় করে দেয়। একদিন সকিনাকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যায়।

তাতেই এলাকার লোকজন টিপ্পনী কাটে। জরিনার দিকে আঙুল তুলে কথা বলে। আড়চোখে তাকায়। এমনকি চরিত্রহীন বলতেও দ্বিধা করে না। কেউ কেউ বলে, ‘এবার নজুর তাইলে একটা গতি অইলো।’ সধবা নারীরা বলে, ‘যাউক, বিধবা জরিনাও তাইলে একটা আশ্রয় পাইলো।’ মুরব্বিরা ভাবে, এখন দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। এই সব টিপ্পনীর উদ্ভাবক কিন্তু লতু মাতুব্বর। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধার মনে হয় না তার কাছে। কারণ অলিলের মৃত্যুর পরপরই চোখ রেখেছিল লতু মাতুব্বর। ইশারায় কিছু বলতেও চেয়েছিল জরিনাকে। কাঁচা বয়সের একটা মেয়ে। কলি থেকে ফুল ফোটার আগেই ঝরে যাবে?

কিন্তু বিশেষ সুবিধা হয় না নজুর কারণে। অকাজের ঢেঁকি নজুটা জরিনার বাড়ির আশপাশেই যেন থাকে। লতু মাতুব্বর ভাবে, জরিনা কি পাত্তা দেয় নজুকে? উত্তর খুঁজে পায় না কোনোভাবেই। হিসাব মেলাতে পারে না। তারপরও নজুকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়। নজু কেন এই ঘরে আসে রাত-বিরাতে? তাই তো চোখ রাখে লতু মাতুব্বর। পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকেছে নজু। পাশের খাটিয়ায় ঘুমায় সকিনা। রাত তেমন বেশি নয়। সুইচ টিপে হাতঘড়িতে টাইম দেখে। কেবল আটটা বাজে। চারদিকে ঘুটঘুটে আন্ধার। তবে আটটাই গ্রামে অনেক রাত। কেরোসিন পুড়ে রাত জেগে থাকে না বেশির ভাগ মানুষ। দু’চার ঘরে যারা পড়াশোনা করে; তাদের ঘরে কেবল মিটমিট করে জ্বলতে থাকে হারিকেন।

জরিনার ঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগটি নামিয়ে নজু বলে, ‘ভাবি, দ্যাহো তো পিঠটায় জানি কিহের আঁচোড় লাগছে।’

ডেউকরা থেকে তেলের বাতিটা হাতে নিয়ে আঁতকে ওঠে জরিনা, ‘হায় আল্লাহ করছো কী নজু?’

‘ক্যান কী অইছে ভাবি?’ স্বাভাবিক জবাব নজুর। 

‘পিঠ তো দুই ভাগ অইয়া গেছে। তুমি খাড়াও। আমি পাকিস্তানি পাতা আনি।’

বলেই জরিনা বাতিটা হাতে নিয়েই ছুটে যায় ঘরের পেছনে। ঘরের পেছনে কয়েকটা গাছের কারণে জঙ্গলের মতোই মনে হয়। সেখান থেকে দুটি পাকিস্তানি পাতা ছিঁড়ে আনে।

দুই হাতের তালুতে ঘষতে ঘষতে রস বের করে জরিনা বলে, ‘তুমি জামাডা খুইলা উবুত হইয়া শোও তো।’

ঘরের মধ্যে জরিনার এমন কথা শুনে নড়েচড়ে দাঁড়ায় লতু মাতুব্বর। এদিক-ওদিক তাকায়। তিন ব্যাটারির লাইট জ্বেলে যাচ্ছিল কলিম শেখ। সেই আলো এসে পড়ে লতুর মুখে। ‘কী করো লতু...’ বলার আগেই ইশারায় থামতে বলে। কাছে ডাকে কলিম শেখকে। কাছে যেতেই পাটখড়ির বেড়া আরেকটু ফাঁকা করে দেখায়। উবু হয়ে শোওয়া নজুর পিঠে পাকিস্তানি পাতার রস ডলে দিচ্ছে জরিনা। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয় লতু মাতুব্বর। সেই উত্তেজনা হয়তো কামনার, নয়তো ক্ষোভের।

কলিম শেখকে সাথে নিয়ে ধাক্কা মারে জরিনার দরজায়। দরজা ভেজানো ছিল। এক ধাক্কায়ই খুলে যায়। লাইট পড়ে জরিনার মুখে। আলোর ঝলকে নড়তে পারে না সে। লতু মাতুব্বর এগিয়ে আসে নজুর দিকে। ‘আইজ হাতেনাতে ধরছি রে নজু। পালাবি কই?’ বলেই হো হো করে হেসে ওঠে।

মেজাজ বিগড়ে যায় নজুর। মাথার কাছেই ছিল ছেনদাটা। নজু হাতে তুলে নেয়। সজোরে কোপ মারে। এক কোপে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসে। জায়গায় ঢলে পড়ে লতু মাতুব্বর। ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করে কলিম শেখ। ঘুম ভেঙে যায় সকিনার। চোখ ডলতে ডলতে কেঁদে ওঠে সেও। তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় নজু এবার চিত হয়ে শুয়েই থাকে। পাশেই পড়ে আছে লতু মাতুব্বরের নিথর দেহ। গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর। কেউ আসে ক্ষেতের আল ধরে। কেউ কাঁচা রাস্তায় উষ্টা-গুঁতা খেতে খেতে। তাদের কারও হাতে হারিকেন। কারও হাতে লাইট বা বাতি। আলোয় ভরে যায় জরিনার ঘর।  চিৎকার-চেঁচামেচিতে জেগে ওঠে গ্রাম। 

গ্রামের মুরব্বি কয়েকজন বলেন, ‘কী হইছে রে কলিম, এবার এট্টু খুইলা কঅ।’

‘কী আর অইবো কাকা? এই সব নাখারাস্ত কাম কি সহ্য করা যায়? দেহেন লতু ভাই পইড়া আছে। এক কোপ দিছে নজু। এহোনো খালি গায় শুইয়া আছে। বাকিডা কইতে অইবো? খুন, পুরাই খুন কাকা।’
‘আজেবাজে কতা কবি না কলিম।’ বলেই নজুর হাত থেকে দাটা নিয়ে তেড়ে আসে জরিনা। ধরে ফেলে দুই-তিনজন নারী।

‘করোস কী জরিনা? মান খুয়াইয়া লতুর জানডা খাইলি। এহোন কি নিজের জানডাও খুয়াইবি?’

‘কী কন এই সব আপনেরা? আমরা তো খারাপ কিছু করি নাই। আমাগো খারাপ উদ্দেশ্য আছিল না। লতু কাকার হাঁকডাকে ভয় পাইয়া নজু কামডা কইরা ফালাইছে। ইচ্ছা কইরা করে নাই।’

‘কী রে কলিম, তুই কবি কিছু?’ প্রশ্ন করে একজন। বাইরে তখন উত্তেজিত জনতার গুঞ্জন শোনা যায়। শুধু মুরব্বিদের আদেশের অপেক্ষায় তারা। না হলে এতক্ষণে নজুকেও শেষ করে দিত। তাছাড়া লতু মাতুব্বরের পরিবার গেছে বাপের বাড়ি।

পুলিশ আসার আগে লাশ ধরবে না কেউ। নজু বলে সবার উদ্দেশে, ‘আমার আর কিছু কওয়ার নাই। যা কওয়ার থানায়ই কমু। এই নজুরে বাইন্ধা রাহো সবাই। আমি খবর দিতাছি থানায়।’

জরিনার কপাল আবারও পোড়ে। তার জন্য আজ লতু মাতুব্বর খুন হয়। সহজ-সরল পরোপকারী নজুর কপালে জোটে খুনির তকমা। তাই তো আজ নিজেকেই অপয়া মনে হয়। সকিনাকে জড়িয়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে জরিনা।

সারা রাত জেগে থাকে কাশীপুর গ্রাম। দুচোখের পাতা এক করে না কেউ। জরিনার বাড়ি পাহারা দেয় গ্রামের যুবসমাজ। খুব ভোরে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় নজুকে। তারপর মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। লতু মাতুব্বরের পক্ষে সাক্ষী কলিম শেখ। নজুর পক্ষে জরিনা। মামলার রায় কী হবে জানে না সে। শুধু নজুর জন্য মায়া হয় তার। আর্দ্র হয়ে ওঠে চোখ। বুকের বাঁপাশে চিনচিন করে ওঠে। জরিনা ভাবে, হায় রে দুনিয়া! উপকার করতে এসে লোকটা নিজেই পড়ল বিপদে। কে শুনবে কার কথা? স্বার্থ ছাড়া কে কবে উপকার করেছে কার? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। না নজুর কাছে, না জরিনার কাছে। 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!