• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইয়ুন ফস্সের প্রত্যাশিত নোবেলপ্রাপ্তি


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৩, ০২:০৬ পিএম
ইয়ুন ফস্সের প্রত্যাশিত নোবেলপ্রাপ্তি

প্রথমেই সবিনয়ে কবুল করে নিই, দু-একটি ছোটখাটো মন্তব্য-নিবন্ধ কিংবা সাক্ষাৎকারের বাইরে এবারের সাহিত্যের নোবেল বিজয়ী, নরওয়ের ইয়ুন ওলাভ ফস্সের (তাঁর নামের সঠিক উচ্চারণটাও জেনেছি এই তো সেদিন আমার এক নরওয়ে প্রত্যাগত বন্ধুর কাছ থেকে) তেমন কোনো লেখাপত্র পড়ে ওঠার সুযোগ কিংবা সৌভাগ্য হয়নি এই নিবন্ধকারের। তবে তাঁর নাম ও কীর্তির কথা জানা ছিল বিলক্ষণ। অবশ্য সেটিও খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১৯ সালে ঢাকার গ্যোয়টে ইনস্টিটিউটের দৌত্যে এবং জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আমন্ত্রণে তাদের বিশ্ববিখ্যাত থিয়েটারট্রেফেন নাট্যোৎসবে যোগদানের জন্য আমার বার্লিন যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আমন্ত্রিত আরও উনিশজন নাট্যজনের সঙ্গে। সেখানেই লক্ষ করি, নাটকবিষয়ক নানা সেমিনার, বক্তৃতায় ইয়ুন ফস্সের কথা উঠে আসছিল বারবার। তখন জানতে পারি, তিনি সেই মুহূর্তে পুরো ইউরোপের সবচেয়ে সক্রিয়, শ্রদ্ধেয় ও গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার, যাঁর নাটক জার্মানিসহ ইউরোপের মঞ্চে সর্বাধিকবার মঞ্চস্থ হওয়ার সুনামেরও অধিকারী।

তো, জার্মানি থেকে ফিরে আসার পর তাঁর সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখা গেল নিজের দেশ নরওয়েতে তিনি রীতিমতো একজন তারকা লেখক, যেখানকার সাহিত্যবোদ্ধারা তাঁকে ‘নতুন ইবসেন’ নামে সম্বোধন করে থাকেন, তাঁর প্রবল নাট্যপ্রীতি এবং বিশেষ করে ইবসেনীয় নাট্যচিন্তা ও প্রকরণের আধুনিক প্রবক্তা ও চর্চাকারী হিসেবে। নরওয়ের হেন কোনো মর্যাদাবান সাহিত্য পুরস্কার  কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, যা ইয়ুন ফস্সে পাননি। অন্যদিকে ফ্রান্সেও তাঁর দারুণ সুখ্যাতি ও সম্মান, এতটাই যে সে দেশের সরকারও তাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আর ফরাসি নাট্যবোদ্ধারা তো তাঁকে এ যুগের আরেক স্যামুয়েল বেকেট হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসেন। তারপর মধুর বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, প্রতিবছরই নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগেভাগে তাঁর পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে,এমনকি সাহিত্য-জুয়াড়িরা সম্ভাব্য পুরস্কারপ্রাপকদের যে দীর্ঘ তালিকাটি প্রকাশ করে থাকে ফিবছর, তাতেও ইয়ুনের নাম থাকে সামনের দিকেই।

এ বছর তো একেবারে প্রথম তিনজনের মধ্যেই ছিল ফস্সের নাম। এবার তাই নোবেল পুরস্কার ঘোষণার ঠিক আগের দিনই আমাদের এক প্রবীণ সাহিত্যিকের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে আমি যে তাঁর পুরস্কার পাওয়ার পক্ষে আমার মতামত ব্যক্ত করেছিলাম তার ভিত্তি আর কিছু নয়, আমার  সেই জার্মান অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন হ্রস্বতালিকায় ওপরের দিকে তাঁর নামের অবস্থান এবং সেই সঙ্গে আরও একটি বিশেষ বিবেচনার সমীকরণ। সেই বিবেচনাটি হলো: নাট্যসাহিত্য। আমরা জানি, নোবেল পুরস্কারের ১১৪ বছরের ইতিহাসে সাকল্যে জনা দশেক মাত্র নাটকের জন্য এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মরিস মেটারলিঙ্ক (১৯১১), জর্জ বার্নার্ড শ (১৯২৫), লুইজি পিরান্দেল্লো (১৯৩৪), ইউজিন ও’নিল (১৯৩৬),স্যামুয়েল বেকেট (১৯৬৯), দারিও ফো (১৯৯৭) যাঁদের অন্যতম। সর্বশেষ যে নাট্যকারের ভাগ্যে এই পুরস্কারের শিকে ছিঁড়েছিল তিনি হ্যারল্ড পিন্টার, তা-ও পাক্কা আঠারো বছর আগে, ২০০৫ সালে। আর সে জন্যই গত কবছর ধরে নোবেলের অন্দরমহলে বলাবলি হচ্ছিল একজন নাট্যকারকে এই পুরস্কারটি দেওয়ার ব্যাপারে, কেননা সাম্প্রতিককালে সাংবাদিক ( স্ভেতলানা আলেক্সিভিচ), গীতিকার (বব ডিলান) কাউকেই তো তাঁরা বাদ রাখেননি এই পুরস্কারের প্রাপ্তিযোগ থেকে। 

সে ক্ষেত্রে ইয়ুনের চেয়ে যোগ্য আর কেই-বা আছেন। একে তিনি বহুপ্রজ নাট্যকার, যাঁর রচিত নাটকের সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি, তায় আবার ইউরোপজুড়ে বহুল প্রশংসিত ও সর্বাধিক মঞ্চস্থ তাঁর নাটক। এ-ও যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে তার সঙ্গে সহজেই যোগ করে দেওয়া যেতে পারে তাঁর কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও শিশুসাহিত্যিক পরিচয়টুকুও, সব মিলিয়ে যিনি একজন আপাদমস্তক সাহিত্যিক এবং যাঁর মোট বইয়ের সংখ্যা সত্তরোর্ধ্ব। আর এই সামগ্রিক বিবেচনাতেই তিনি নোবেল কমিটির অপর দুই প্রিয় পছন্দ অস্ট্রেলীয় জেরাল্ড মারনান ও চিনের ক্যান শুয়ে, কিংবা এমনকি চিরপ্রত্যাশিত হারুকি মুরাকামিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারেন, সে রকম একটি ধারণা ক্রমে দানা বাঁধছিল এই অধমের মনে, যা কিনা মুখ ফুটে প্রকাশের পরদিনই সত্য প্রমাণিত হয়।

অবশ্য এর অর্থ এ-ই নয় যে, স্রেফ সমীকরণের ফলাফলে ফস্সে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন দৈবাৎ। সাহিত্যিক বিবেচনার কথা বলতে গেলে সংখ্যায় ও শক্তিমত্তায়, গুণে ও মানে অন্তত নাটকে যে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই এই মুহূর্তে সে কথা তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করবেন নির্দ্বিধায়। এর সঙ্গে যদি আর কিছু না হোক তাঁর উপন্যাসের অর্জনকেই শুধু যুক্ত করা যায় তাহলেই তো পুরস্কারপ্রাপ্তির পাল্লাটা তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়বে অনেকটা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কথাসাহিত্যিক হিসেবেও ফস্সের এমন সুনাম, সামর্থ্য ও গুণপনার কথা প্রথম জানতে পারি আমি তাঁরই এক স্বদেশি শিষ্য, কাকতালীয়ভাবে যাঁর নামও ছিল এবারের নোবেলের হ্রস্বতালিকায়, কার্ল ওভে নোসগার্ডের লেখা থেকে। গেল বছর তাঁর ছোট উপন্যাস ফাদারহুড পড়ার সময় তাঁর গুরু ফস্সে বিষয়ে তাঁর একটি নিবন্ধ পাঠেরও সুযোগ হয় আমার। সেখানেই তিনি তাঁর শিক্ষক ইয়ুন ফস্সের সাহিত্যের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর কাছে ঋণস্বীকারের পাশাপাশি তাঁর প্রবন্ধসাহিত্য ও উপন্যাসের বিষয়ভাবনা এবং রচনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্য ও  মৌলিকতা বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। 

আমরা জানি ফস্সে প্রধানত নাট্যকার হলেও তিনি সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন একটি উপন্যাস রেড, ব্ল্যাক (১৯৮৩) প্রকাশের মাধ্যমেই। এরপর তিনি আরও প্রায় দুই ডজনের মতো উপন্যাসও রচনা করেছেন। তবে ২০১৯ সাল থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর সাতখণ্ডের মহাকাব্যিক রচনা সেপ্টোলজি  তাঁকে একেবারে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। Damion Searls এর ইংরেজি অনুবাদে যৌথভাবে এর ষষ্ঠ ও সপ্তম খণ্ডদ্বয়, A New Name: Septology VI-VII  বইটি ২০২২ সালে International Booker Prize এর হ্রস্বতালিকায় এবং ২০২৩ সালে National Book Critics Circle Award এর চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পায়। উল্লেখ্য, তাঁর এই সেপ্টোলজি  উপন্যাসের লেখার ধরন বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ফস্সে একদা বলেছিলেন, এটি হচ্ছে দ্রুতগতির এই পৃথিবীতে একপ্রকার Slow Writing এর নিদর্শন।

সে যাক, ইয়ুন ওলাভ ফস্সের সাহিত্যবিষয়ে কার্ল ওভে নোসগার্ডের সেই নিবন্ধের একটি উক্তি উদ্ধৃত করেই আমার এই নাতিদীর্ঘ রচনার ইতি টানতে চাই, কেননা এর মধ্য দিয়ে ফস্সের স্বতন্ত্র সাহিত্যচিন্তা ও সুগভীর জীবনবীক্ষার যে প্রগাঢ় পরিচয় ফুটে ওঠে তার জুড়ি মেলা সত্যি ভার। নোসগার্ড লিখেছিলেন, “No one has written more perceptively about Jon Fosse’s literature than Lev Tolstoy in War and Peace, in the passage where the main character, Prince Andrei, is moved to tears when listening to a piece of music and endeavours to understand why. He finds reason in the terrible contrast between the illimitable infinity within him and the constraint of his worldly materiality. This contrast, between the infinity within us and the constraints of the external, propels everything Jon Fosse has written.” (ওয়ার অ্যান্ড পিস উপন্যাসের সেই বিশেষ স্তবকটির, যেখানে এর প্রধান চরিত্র প্রিন্স আন্দ্রেই একটি সংগীত শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেন এবং তাঁর কান্নার কারণটি বুঝতে চেষ্টা করেন, রচয়িতা লিও তলস্তয় ছাড়া আর কেউই ইয়ুন ফস্সের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে এমন সংবেদনশীলতার সঙ্গে লিখতে পারেননি। আন্দ্রেই তাঁর ভেতরের সীমাহীন অসীমতা এবং তাঁর পার্থিব বস্তুতান্ত্রিকতার মধ্যেকার ভয়ংকর বৈপরীত্যের মধ্যে সেই কারণকে খুঁজে পেয়েছিলেন। আমাদের ভেতরের অসীমতা  ও বাইরের যাবতীয় সীমাবদ্ধতার এই দ্বন্দ্বই ইয়ুন ফস্সেকে তাড়িত করেছে তাঁর সকল সাহিত্যসৃষ্টির কাজে। ৩০ সেপ্টেম্বর,২০১৯)

ইয়ুন ফস্সের নিগূঢ় অন্তর্জগৎ ও সুমহান সৃষ্টিপৃথিবীকে বুঝবার জন্য আরেক মেধাবী কথাসাহিত্যিক, তাঁর স্বদেশি Carl Ove Knausgaard এর এই একটি উক্তিই যথেষ্ট বলে মনে করি।
 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!