• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

হাংরিয়ালিজম মলয় রায়চৌধুরী : সাহিত্য আন্দোলনে নতুন আলাপ


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৩, ১০:৩৮ এএম
হাংরিয়ালিজম মলয় রায়চৌধুরী : সাহিত্য আন্দোলনে নতুন আলাপ

মলয় রায়চৌধুরীকে বলা হয় হাংরি প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধি। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকে আন্দোলনের নাম, ‘অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট’ বইটি থেকে মতাদর্শ ধার করে হাংরি আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬১ সালে জন্ম নেওয়া এ আন্দোলনটি বছর কয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। যারা সাহিত্য আন্দোলনের খোঁজ রাখেন এসব তাদের জানা।

১৯৬৪ সালে হাংরি আন্দোলনের ১১ বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। মলয় রায়চৌধুরীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে কবিতা লিখে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। পরে বিভিন্ন ভাষায় এই কবিতাটি অনুদিত হয়। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন আন্দোলনের সাথী শৈলেশ্বর, সুভাষ প্রমুখরা। আবার পক্ষে সাক্ষ্য দেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন, জ্যোতির্ময় দত্তরা। মলয় উচ্চ আদালত থেকে ছাড়া পান। ততদিনে তিনি বাংলা ভাষায় উত্তরাধুনিক সাহিত্যচিন্তা ও হাংরি আন্দোলনের জন্য একই সঙ্গে বিশ্বনন্দিত এবং নিন্দিতও।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, কৃত্তিবাসীরা মলয়দের উত্থানে ভীত-সন্ত্রস্ত। তিনি একই সঙ্গে অভিযোগও জানান, মলয় হাংরি আন্দোলনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন সুনীলের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতির সময়টাই। মামলার কারণে হাংরিদের কেউ চাকরি হারিয়েছিলেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিষ্কৃত হয়েছিলেন, গ্রেপ্তারের সময়ে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছিল তাদের বাড়িঘর।

১৯৬১ সালে বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়ার (দেবী রায়) সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করেই সাড়া ফেলে দেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতায় প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ। মলয় রায়চৌধুরীরা শুরু থেকেই বাংলা ভাষার উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঘরানায় পুষ্ট সাহিত্যচর্চাকে ধাক্কা দিতেই চেয়েছিলেন। চিন্তা-চেতনা, প্রচলিত ছন্দ ও শব্দের অচলায়তন ভেঙে নতুনের সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন।  

এই আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হতো। ১৯৬৫ পর্যন্ত এই আন্দোলন পুরোদমে চলেছিল; বিখ্যাত হাংরি মামলার পর তা ভেঙে যায়। আন্দোলনটি নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি কিংবদন্তি নামে একটি গ্রন্থে আন্দোলনের ইতিহাস তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। পরবর্তীকালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নথিপত্র, আদালতে সাক্ষ্য, আদালতের রায় এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয় হাংরি আন্দোলন গ্রন্থ। মলয় রায়চৌধুরী তিরিশ বছর ধরে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেগুলি একত্রিত করে প্রকাশ করেছেন প্রতিভাস প্রকাশনী।

দুই।
১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর, সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা খ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে জন্ম হয় মলয় রায়চৌধুরীর। তার বাবা গৌচপ্রম রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী ও ফটোগ্রাফার। তার মা অমিতা ছিলেন পাণিহাটি স্থিত নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (রোনাল্ড রস-এর সহায়ক) বড় মেয়ে। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদের সংরক্ষিত সংগ্রহশালার (মিউজিয়াম) তথ্য অনুযায়ী মলয় রায়চৌধুরীর ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার-শিল্পী। তার দাদা সমীর রায়চৌধুরীও একজন লেখক।

তিন। 
মলয় তখন ২২ বছরের যুবক। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। কবি জিওফ্রে চসারের (১৯৩৯–১৪০০) In The Sowre Hungry Tyme পড়ে মলয় Hungry শব্দের অভিঘাতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। হাংরির পরিকল্পনা তখন থেকেই। সময়ের প্রেক্ষাপটটিও গুরুত্বপূর্ণ।

সদ্য স্বাধীন দেশ। দেশভাগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়। দারিদ্র, ক্ষুধা, নিরন্ন মানুষ। বাংলা কবিতার হালও খুব খারাপ। ৩০–৪০-এর গতানুগতিক কবিতা নির্জীব হচ্ছে। ৫০-এর কবিরা সবে নিজেদের প্রকাশ করছেন। নিজস্বভূমি আবিষ্কার হয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় এলেন পাটনায়। মলয় শক্তিকে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলেন। প্রথম বুলেটিনে কবিতা বিষয়ক একটি ইশতাহার ইংরেজিতে ছাপা হলো।

১৯৬২ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলায় প্রথম ইশতেহারটি প্রকাশ পায়। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০৭টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ পায়। এইসব বুলেটিনে প্রকাশের কোনো তারিখ থাকতো না। নানা রঙের কাগজে, এমনকি মলাটের বাদামি কাগজেও বেরোতো এক সপ্তাহে ২৪টি আবার কখনও বছরে একটি হয়তো।

হাংরি সূচনাকালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র চারজন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী। এরপর একে একে যুক্ত হন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, অরুণেশ ঘোষ, সুবোধ আচার্য প্রমুখ।

ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে অস্বীকার ও প্রচলিত গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখালিখিতে নতুন আবিষ্কারই প্রকৃত সাহসী ও মৌলিক পথ মানতো হাংরিরা। কৃত্তিবাস বা শতভিষা গোষ্ঠী হাংরি আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেনি। প্রবীণ সাহিত্যকাররাও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন হাংরিদের সম্পর্কে। সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে হাংরি গোষ্ঠী।

অথচ সর্বভারতীয় ভাষায় ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি তরুণ লেখকরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। অন্য ভারতীয় ভাষার পত্রপত্রিকায় প্রভাব পড়েছিল হাংরি আন্দোলনের। মারাঠি ভাষার লেখক অশোক সাহানে, দিলীপ চিত্রে, অরুণ কোলটকর প্রমুখ, তেলেগু ভাষায় নিখিলেশ্বর, নগ্নমুনি, জ্বলামুখী প্রমুখ। হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ হাংরি লেখকদের মূল্যায়ন করেন। বহির্বিশ্বেও হাংরি আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৬৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে হাংরি জেনারেশনের একটি বুলেটিনকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতার অভিযোগে মলয় রায়চৌধুরীসহ হাংরিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। ৪৮ শঙ্কর হালদার লেন, আহিরিটোলা, কলকাতা-৫ থেকে ওই সংখ্যায় দশজন লেখক ও প্রকাশক সমীর রায়চৌধুরীর নাম পাওয়া যায়। লেখক তালিকায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ও সুবো আচার্য। এই বুলেটিনেই প্রকাশ পায় মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি।

এই কবিতাকে কেন্দ্র করে অশ্লীল রচনার দায়ে হাংরি জেনারেশন পত্রিকার বিরুদ্ধে লালবাজার প্রেস সেকশনের সাব ইন্সপেক্টর কালীকিঙ্কর দাস অভিযোগ আনলেন। শুরু হলো ধড়পাকড়। ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ধরা হলো ৬ জনকে। মামলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন মামলা চলল। ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এই ১৯৬৫ সালেই হাংরি আন্দোলনের ইতি ঘটে। এই বছরেই ২৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর সাজা হয়। পরে, ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই মলয় রায়চৌধুরী হাইকোর্টে পিটিশন করলে তাকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি দেওয়া হয়।

আন্দোলনের কথা পৌঁছে যায় নিউইয়র্কের TIME পত্রিকায়। এই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি পত্রিকা বিদেশে প্রচারিত হলো। প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি জেনারেশনের এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেল।

চার। 
মলয় রায়চৌধুরীর একটি কবিতা পড়ে থ মেরে যাই। সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগ নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতার অসাধারণ মর্মান্তিক এবং ভায়াবহ চিত্রকল্প চমকে দেয়! ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ ঝুলতে ঝুলতে একবার পাকিস্তান আবার হিন্দুস্থানের দিকে ঝুলছে! আহরে রায়ওট!!

মেজদা বলল, “চল চল দেখে আসি, টিনের কারখানায় ঝুলে-ঝুলে
পাক খাচ্ছে কেউ”। দৌড়োলুম, ম্যাজিক দেখবো ভেবে—
ক্যানেস্তারা কেটে টিনগুলো কাঠের হাতুড়ি পিটে সোজা করে।
অতো উঁচুতে কেমন করে চড়েছিল ধুতি-শার্ট পরা রোগাটে লোকটা?
চশমা রয়েছে চোখে! ভালো করে দেখে বললুম, “মেজদা
ইনি তো আমাদের ক্লাসের অরবিন্দর বাবা; ওরা দেশভাগে
পালিয়ে এসেছিল ফরিদপুর থেকে, সেখানে ইশকুলে পড়াতেন,
কিন্তু সার্টিফিকেট-টিকেট ফেলে জ্বলন্ত ঘর-দালান ছেড়ে
চলে এসেছেন বলে কোথাও পাননি কাজ, শেষে এই টিনের
শব্দ প্রতিদিন বলেছে ওনাকে, কী লজ্জা, কী লজ্জা, ছিছি…”
কিন্তু অতোটা ওপরে উঠলেন কেমন করে! টিনবাঁধার দড়ি খুলে
গলায় ফাঁস বেঁধে ঝুলছেন এখন, পাকও খাচ্ছেন, একবার বাঁদিকে
হি…ন..দু…স…তা…ন…আরেকবার ডানদিকে…পা…কি…স…তা…ন

‘যা লাগবে বলবেন’ (১৯৯৬) কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় মলয় রায়চৌধুরী নিজের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন—‘আমার কবিতা আসলে কবিতা-বিরোধী, যা আনুষ্ঠানিকতা নয়, যা সৃজনশীলতা ভাঙে, ছড়ানো ছেটানোর অবশিষ্টাংশ, ছিন্নভিন্ন মানসিকতায় অস্থির, অনির্ণেয়, অস্বস্তিকারক, শৈলীহীন, ছকের বাইরে, পূর্বপুরুষের আদলে দেখতে নয়, লেখক যার মধ্যে নিজের অনুপস্থিতির দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, খোলামেলা, ফুরিয়ে যাবার ইতিবৃত্ত, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, ব্যাখ্যার অযোগ্য, বিসদৃশ, অস্পষ্ট, ধারাবাহিকতাহীন, এলোপাথাড়ি, উচ্ছৃঙ্খল, বিপথগামী, জঘন্য, বিকলাঙ্গ, বিকেন্দ্রিত, স্থানচ্যূত, অসম্বদ্ধ, অসংজ্ঞায়িত, অবৈধ, মূল উপাদান থেকে আলাদা, ক্ষয়ক্ষতি থেকে উদ্গত। যে কোনো সাধারণ মানুষের মতন আমার অভিজ্ঞতাও লুকিয়ে-লুকিয়ে চুপচাপ একা-একা সংগৃহীত। অতয়েব পাঠবস্তুর মধ্যে বিষাক্ত ছুঁচ, ভাঙা কাঁচি, পচা তোয়ালে, বাসি কনডোম, বারবিটুরেট থাকছে।’ মলয় রায়চৌধুরীর উদ্দেশ্য ছিল কবিতায় ব্যতিক্রমী চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটানো। এই নতুন চিন্তার উল্লেখযোগ্য ফসল তাঁর প্রথম কাবগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ (১৯৬৩) এর ‘কল্পক্রম’ কবিতা।

পাঁচ। 

দুই শতাধিক বই লিখেছেন মলয়। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস ও অনুবাদ সাহিত্যেও তিনি সমান পারদর্শী। বন্ধু গিনেসবার্গ ও ওরোলভস্কিদের সাহচর্যে মলয় পরিচিত হন বিট সাহিত্য আন্দোলনের কবিদের সঙ্গে। তাদের অধিকাংশের বইয়েরই অনুবাদক মলয়। কবি পরিচিতি ছাড়াও মলয় রায়চৌধুরী উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবি এবং সর্বোপরি ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলন বা হাংরিয়ালিজম তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাকে কেউ কেউ মনে করেন জলজলে তারা!

বাংলা সাহিত্যের লুতুপুতু মধ্যবিত্ত জীবনচর্চার বিরুদ্ধে মলয়ের গদ্যও সুবিশাল থাপ্পড়। মলয়ের সাহিত্যের কেন্দ্রে ছিল প্রান্তজন। ভাষা ও প্রতিষ্ঠানকে আজীবন আক্রমণকারী মলয়ের চর্মরোগ ও ছোটলোকের ছেলেবেলা পড়লে বোঝা যায় তিনি কিভাবে বাংলা সাহিত্যের কলকাতা কেন্দ্রিকতাকে ভেঙে নিজেই এক প্রতিষ্ঠান ভাঙার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের দেওয়া পুরস্কারও অনায়াস প্রত্যাখ্যান করেছেন মলয়। সেটা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার হলেও তা নেননি। মলয়ের ভক্ত সংখ্যা সুবিশাল, তার অনুসরণকারী বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতার বাইরে পথ হাঁটা মেধাবী তরুণরা।

রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে মুষ্টিমেয় কবি-লেখক সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে স্বীকৃতি পেয়েছেন মলয় তাদের একজন। আত্মপ্রচারক, স্বধর্ম-মেধা-সাহিত্য-চর্চায় সোচ্চার, ন্যারেটিভ ভেঙে নতুন ন্যারেটিভের জন্মদাতা মলয় সম্ভবত কলকাতার পত্তনকারী সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের উত্তর পুরুষ। স্বাভাবিকভাবেই মলয় নেতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একজন সাম্রাজ্য পতনকারীও। তাই তাকে নিয়ে আমৃত্যু বিতর্ক চলতেই থেকেছে। যেমন তিনিই সেই মানুষ যিনি আমৃত্যু ফর বাই অ্যান্ড অব দ্য লিটল ম্যাগাজিন।

সেই সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে তিনি চলে গেলেন। রেখে গেলেন এক সুবিশাল বিতর্কিত উত্তরাধিকার। মলয় রায় চৌধুরীর মৃত্যু একটি সাহিত্য আন্দোলনের বিষয়-আশয় নিয়ে নতুন আলাপের দরোজা খুলে দিলো। এটা আরও দীর্ঘ হবে। সুবিস্তৃত হবে। 

Link copied!