• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সন্তান গ্রহণে অনীহা, দক্ষিণ কোরিয়ায় বাড়ছে ‘নো-কিডস জোন’


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৩, ০২:৪৬ পিএম
সন্তান গ্রহণে অনীহা, দক্ষিণ কোরিয়ায় বাড়ছে ‘নো-কিডস জোন’

দক্ষিণ কোরিয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড়দের জন্য ঝামেলামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে দেশটির ক্যাফে, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন জায়গা ‘নো-কিডস জোন’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন জন্মহার বিদ্যমান।

একদিকে দেশটিতে নারীদের সন্তান ধারণ করতে উৎসাহিত করতে শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে, অন্যদিকে ক্যাফে ও রেস্তোরাঁর মতো জায়গা শিশুদের নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এ দুটি বিষয় বিপরীতমুখী এবং পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের দেশটিতে ‘নো-কিডস জোন’ সংস্কৃতি!

মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। এতে বলা হয়, শত শত ‘নো-কিডস জোন’ ছড়িয়ে রয়েছে দেশটির আনাচে-কানাচে, যার লক্ষ্য মূলত বড়দের জন্য ঝামেলামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।

একটি স্থানীয় থিঙ্কট্যাংকের মতে, শুধু জেজুর হলিডে দ্বীপে এ রকম প্রায় ৮০টি জোন রয়েছে। অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলো মতে, বাকি অঞ্চলগুলোতে চার শতাধিক ‘নো-কিডস জোন’ রয়েছে।

দেশটির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাগত সমস্যার মধ্যে শিশুদের বিভিন্ন স্থানে এভাবে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহারের পাশাপাশি, দক্ষিণ কোরিয়ায় বিশ্বের দ্রুততম বার্ধক্য জনসংখ্যার মত সমস্যা রয়েছে।

গত বছর, দক্ষিণ কোরিয়ার সন্তান জন্মদানের হার শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ যা রেকর্ড সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এমনকি স্থিতিশীল জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় ২ দশমিক ১ এর অর্ধেকও নয়। যেখানে জাপানের সন্তান জন্মহার ১ দশমিক ৩ থেকেও অনেক কম।

তরুণ দক্ষিণ কোরিয়ানরা এ বিষয়ে বিভিন্ন দিক থেকে সবচেয়ে চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। কেননা, দেশটিতে উচ্চ রিয়েল এস্টেট ব্যয় এবং দীর্ঘ কর্ম সপ্তাহ, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট নাগরিকদের সন্তান নিতে কিংবা পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে অনীহার সৃষ্টি করছে। এসব জটিলতার কারণে একটি পরিবার শুরু করার বিষয়টি নিয়ে তাদের তা দুবার ভাবতে বাধ্য করে।

গত ১৬ বছরে দেশটির সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ২০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যাতে নাগরিকরা সন্তান নেওয়ার জন্য উৎসাহিত হয়। তবে সমালোচকরা বলছেন, এ সমস্যার সমাধানে বেশি অর্থ ব্যয় করার পরিবর্তে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য কাজ করা দরকার।

সমাজের পুনর্জন্ম

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ দক্ষিণ কোরিয়ানরা নো-কিডস জোনকে সমর্থন করেন। তাদের এই মানসিকতা পরিবর্তন করা সহজ না। কিন্তু মতামত পরিবর্তন হতে পারে এমন লক্ষণও আছে। কেননা তাদের অনেকেই ‘নো-কিডস জোন’ নীতি মানতে নারাজ।

ইয়ং হাই-ইন নামের একজন মা এবং বেসিক ইনকাম পার্টির একজন আইনপ্রণেতা, তারা দুজনেই তাদের দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির একটি মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে সাধারণত বাচ্চাদের প্রবেশে অনুমতি দেওয়া হয় না।

অনুষ্ঠানে সমবেত আইনপ্রণেতাদের আবেগতাড়িত হয়ে তারা বলেন, “বাচ্চাদের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবন সহজ নয়। আমাদের এমন একটি সমাজে পুনর্জন্ম দিতে হবে যেখানে শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।” এরপর তিনি তার ছেলেকে আলিঙ্গন করেন এবং তাকে মঞ্চের চারপাশে ঘুরতে দেন।

কোরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে জেজু দ্বীপ। সম্প্রতি এ অঞ্চলে নো-কিডস জোন বাতিলে একটি বিল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বনি টিল্যান্ড বলেছেন, যেসব শিশু পরিবারের সঙ্গে ছুটিতে জেজুতে দ্বীপ ভ্রমণ করে তারা অসন্তুষ্ট হয়। কারণ, মনোরম এই দ্বীপের ক্যাফেগুলোতে শিশুদের প্রবেশের অনুমতি নেই।

ঝোলকাণ্ড এবং এমন ধারণা উৎপত্তি

দক্ষিণ কোরিয়ায় নো-কিডস জোনের ধারণাটি ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০১২ সালে একটি রেস্তোরাঁয় ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনা থেকে। রেস্তোরাঁয় একজন ওয়েটার যখন গরম ঝোল বহন করে খাবার টেবিলে দিচ্ছিলেন ঠিক সে সময় এক শিশু তাকে ধাক্কা দেয়। এর থেকে সূত্রপাত নো-কিডস জোন ধারণার।

ঘটনাটি পরবর্তী সময়ে অনলাইনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিশুটির মা ওই ওয়েটারকে আক্রমণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একাধিক পোস্ট করেন। প্রথম দিকে তার প্রতি দেশটির নাগরিকরা অনেক সহানুভূতি দেখান। এমনকি দুর্ঘটনার পরে ওই প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছিল।

কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে যায় যখন নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায় শিশুটি আগে থেকেই রেস্তোরাঁয় ছোটাছুটি করছিল। এ ভিডিও ফুটেজ দেখার পরে জনসাধারণের চিন্তার পরিবর্তন হতে শুরু করে। অনেকে তার সন্তানের আচরণ নিয়ন্ত্রণ না রাখায় ওই মাকে দোষারোপ করতে শুরু করে।

এরপরই মূলত বিষয়টি নিয়ে দেশটিতে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় এবং  ২০১৪ সাল নাগাদ নো-কিডস জোন একটি পরিচিত দৃশ্য হয়ে ওঠে।

২০২১ সালে হ্যানকুক রিসার্চের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জনের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক নো-কিডস জোনের পক্ষে। শুধু কেবল নিঃসন্তান প্রাপ্তবয়স্করাই যে এটি সমর্থন করে, তা নয়। দেশটিতে শান্তি এবং শান্ত থাকার অধিকার এত ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে এমনকি অনেক পিতামাতাও জোনটিকে যুক্তিসংগত এবং ন্যায়সংগত হিসেবে দেখেন।

Link copied!