জেরুজালেমের পবিত্র আল-আকসা মসজিদে অভিযানের নামে মুসল্লিদের ওপর দ্বিতীয় দিনের মতো তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ। বর্তমানে পবিত্র রমজান মাস চলছে। এরমধ্যে বুধবার রাতে হামলার ঘটনা ঘটে। দুই দফা হামলার পর ৩৫০ জন ফিলিস্তিনি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১৪ জন আহত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। এতে বলা হয়, ইসরায়েলি পুলিশ স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে অভিযান চালিয়েছে। ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের ওপর রাবার-কোটেড স্টিল বুলেটও ছুঁড়েছে।
একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সশস্ত্র ইসরায়েলি সৈন্যরা মুসলিমদের তৃতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয়স্থান আল আকসা মসজিদটি জোরপূর্বক খালি করছে। সেসময় ইসরায়েলি পুলিশ লাঠিসোঁটা, টিয়ার গ্যাস, গ্রেনেড এবং ধোঁয়াসৃষ্টিকারী বোমা নিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়ে এবং নারীসহ মুসল্লিদের মারধর ও নির্যাতন করে।
এদিকে মসজিদে মুসল্লিদের ওপর হামলার ঘটনায় ফিলিস্তিনের সমগ্র পশ্চিমতীরজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, সর্বশেষ অভিযানে অন্তত ছয়জন আহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের ওয়াফা নিউজ এজেন্সি অনুসারে, ইসরায়েলি বাহিনী আল-আকসা প্রাঙ্গণে হামলার পর দখলকৃত পশ্চিম তীরে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে তাতে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী নাবলুসে বিষাক্ত গ্যাস নিক্ষেপ করার পর কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া উত্তরাঞ্চলীয় শহর হেবরনের কাছে বেইত উমর শহরে তাজা গুলিতে আহত হয়েছেন অন্য একজন।
ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তাসংস্থাটি ওয়াফা জানিয়েছে, বেইত উমর শহরের কয়েক ডজন মানুষ বিষাক্ত গ্যাসের কারণে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। জেনিন এবং বেথলেহেম শহরের কাছে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে।
আল জাজিরা জানিয়েছে, আল-আকসা মসজিদে সর্বশেষ হামলার পর সৃষ্ট উত্তেজনা দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে আল-আকসা অভিযানের ‘কঠোর ভাষায়’ নিন্দা করেছে মালয়েশিয়া। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইসরায়েলকে এর জন্য জবাবদিহির করার আহ্বান জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার কুয়ালালামপুর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “ইসরায়েলি বাহিনীর কর্মকাণ্ড বেআইনি, অবমাননাকর । ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার এবং ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থানের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেছে।”
আল-আকসা মসজিদে হামলা ও এর জেরে সৃষ্ট উত্তেজনা নিয়ে আলোচনায় বসছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। কূটনীতিকদের মতে, আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সহিংসতা নিয়ে আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ একটি জরুরি অধিবেশন বসবে।
কূটনীতিকরা বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনের অনুরোধে রুদ্ধদ্বার বৈঠকটি ডাকা হয়েছে।
কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিত সিং পুলিশের অভিযানের সহিংসতাকে “ভয়ঙ্কর, বিরক্তিকর এবং নৃশংস” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি জানিয়েছে, এনডিপি এ অভিযানের বিষয়ে কানাডার সংসদে আলোচনার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবে।
এনডিপির ফেলো ব্লেক ডেসজারলাইস টুইটারে একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “লোকেরা রমজানের জন্য রোজা রাখুক কিংবা পাসওভারে নিপীড়ন থেকে মুক্তির উদযাপন করুক না কেন, সকলের শান্তিপূর্ণ প্রার্থনার অধিকার নিশ্চিত করা উচিত।”
যে কারণে আল-আকসা মসজিদ এত গুরুত্বপূর্ণ:
১৯৬৭ সালে পুরো জেরুজালেম দখলে নেওয়ার পর থেকেই আল-আকসা মসজিদ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ইসরাইল। এরপর নানা বিধিনিষেধ আর শর্ত পূরণের মাধ্যমে সেখানে ইবাদতের সুযোগ পেতেন সাধারণ মুসল্লিরা। তিন সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় প্রতিবছরই রমজান মাসে আল-আকসা ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়। আল-আকসার প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে। সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীর পরই মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান এই আল-আকসা মসজিদ।
পবিত্র আল-আকসা মসজিদ বা বায়তুল মুকাদ্দাস সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান বলে বিবেচিত। তবে জেরুজালেমের এই জায়গাটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও। ইহুদিদের কাছে এটি টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদদের মতে, বছরের পর বছর চলতে থাকা ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে এই পবিত্র মসজিদ।
পবিত্র আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কেবলা হিসেবে পরিচিত। কাবার পর ইসলামে দ্বিতীয় উপাসনাস্থল ছিল এটি। ঐতিহাসিকভাবেই আল-আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান। তারপরও ইউনেস্কো এটিকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে, ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও আল-আকসা মসজিদকে তাদের পবিত্র ভূমি হিসেবে দাবি করে আসছে।
এটি ইহুদিদের কাছে পবিত্র ভূমিখ্যাত ‘টেম্পল মাউন্ট’ বা ‘ঈশ্বরের ঘর’। টেম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ ইহুদিদের কাছে ‘পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসেবে স্বীকৃত। ইহুদিদের দাবি, পবিত্র এই ভূমির নিচেই রয়েছে তাদের দুটি প্রাচীন মন্দির। এখানে নিয়মিত প্রার্থনায় অংশ নেয় লাখো ইহুদি। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও পবিত্রতার দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গা। তাদের বিশ্বাস, এখানেই ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল যিশুকে। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর শহর জেরুজালেম।
২০০৩ সালে জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরাইল। এরপর থেকে সংকট আরও গভীর হতে থাকে। বিভিন্ন সময় ইহুদিরা মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে নিরীহ মুসল্লিদের ওপর হামলা চালানো শুরু করে।