• ঢাকা
  • সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরতে চান কুমিল্লার হানিফ


অঞ্জন আচার্য
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩, ০৭:০৩ পিএম
পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরতে চান কুমিল্লার হানিফ

করাচির মিসকিনাবাদের মাছের বাজারটিতে মানুষের গাদাগাদি। ভন ভন করে মাছি উড়ছে, আর থেমে থেমে বসছে মাছের গায়ে। দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দুপুরের কড়া রোদে মাছগুলোর পচন শুরু হয়ে গেছে, বের হচ্ছে উৎকট গন্ধ। ফুড ব্লগ কুইজিন টিভির ক্যামেরাটি সেদিকেই ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল সব। একসময় ৬৯ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের মুখে এসে স্থির হয় ক্যামেরা। নাম মো. হানিফ। গায়ে মলিন বসন। মুখে স্পষ্ট দারিদ্র্যরেখা। ইংরেজি ধারাভাষ্যের মাঝে হঠাৎ স্পষ্ট বাংলায় উচ্চারণ শুনে কিছুটা থমকে যেতে হয়। তারপর এক না পড়া ইতিহাসের বই কে যেন হাতে তুলে দেন। 
— আপনার জন্মভিটা কোথায়?
— বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায়।
— করাচিতে কবে এলেন?
— ১৯৭১ সালে। 
— কীভাবে এলেন?
— বড় ভাইয়ের হাত ধরে। তখন আমার বয়স ছিল ১৮।
— আসার পেছনে কারণ কী?
— সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে আয়-রোজগার ছিল খুব কম। যা কামাই করতাম, সেটা দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে যেত। মানুষের কাছে শুনেছি, পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে করাচিতে থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা নাকি অনেক বেশি। কাজ করলে আয়-রোজগারও ভালো করা যায়। কোনো অভাব নেই। আসলে, একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় ছুটে আসি।

আধো আধো বাংলায় উপস্থাপক তখন প্রশ্ন করেন—
— এখন কেমন আছেন? 
— দেখতেই পারছেন। এর চেয়ে মনে হয় দোজখ অনেক ভালো।
— এ কথা বলছেন কেন?
— কী আছে আমাদের? পাকিস্তানের সরকার আমাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশও আমাদের তাদের নাগরিক মনে করে না। 
— এখন কি বাংলাদেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে?
—পারলে আজকেই, এখনই সবাইকে নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু…
— কিন্তু কী?
— ওখানে যাব কী করে? গিয়ে খাব কী? ঘরবাড়ি, জমিজামা কিছুই তো আর অবশিষ্ট নেই। জমানো টাকাও নেই যে পরিবার নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকব।
— আপনার পরিবারের সদস্য কয়জন?
— স্ত্রী ও আট ছেলে। তাদের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, মানে নাতি-পুতি মিলে বড় পরিবার। প্রত্যেকের জন্য কিছু একটা কাজের জোগান করতে গেলে তো কোটি টাকা লাগবে। সেই টাকা পাব কোথায়?

— আচ্ছা, করাচির অনেক বাঙালি নাকি নিজেদের ‘বাঙালি’ পরিচয় দিতে চান না। সেটার পেছনে কারণ কী?
— দেয় না, কারণ তারা তাদের পাকিস্তানি পরিচয় দিয়ে মনে করে খুব ভালো অবস্থায় আছে। বাস্তবতা তো তা না। তবে আমাকে যদি অর্ধেক পাকিস্তান কেউ লিখেও দেয়, তবু বলব না আমি এখানে সুখে আছি। আমি যেখানে জন্ম নিয়েছি, সেটার জন্য আজও আমার হৃদয় কাঁদে।

করাচির মিসকিনাবাদ

কথা বলতে বলতে একসময় মো. হানিফের কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। এ যেন কান্নার জলে ইতিহাসের একটি পাতা ওল্টানো।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। তবে স্বাধীনতার পর এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া লাখো বাঙালি। এদের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশে ফিরতে চাননি, এটা যেমন সত্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে। এর ওপর পাকিস্তানও তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তারা হয়ে পড়েন রাষ্ট্রহীন। বহু বছর পরে পাকিস্তান সরকার তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে রাজি হয়। বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ বাঙালি পাকিস্তানে বাস করে, যাদের বেশির ভাগই করাচির বাসিন্দা। তারা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বস্তিতে বাস করেন। বলা হয়ে থাকে, বাঙালিরা পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ জেলে কিংবা কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

মিসকিনাবাদের মাছ ব্যবসায়ী মো. হানিফের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্যা বাঙালির অবস্থা অনেক মাছিবসা মৃত মাছেদের মতো। তাদের চোখগুলো ঘোলাটে। সেই সব চোখে হয়তো আজও স্বপ্ন ঘুরে ফিরে আসে জন্মভিটায় ফিরে যাওয়ার আকুতি। কিন্তু কাঁটাতারে বন্দি রাষ্ট্রহীন মানুষের ঠাঁই নেই কোনো স্বাধীন ভূখণ্ডে। তাই অধরা স্বপ্ন নিয়েই সুদূরে তাকিয়ে থাকেন মো. হানিফ। সেই চোখে কোনো আলো পড়ে না।

তবে বাঙালি নতুন প্রজন্মের স্বর ভিন্ন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ করাচির লিয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ ফাইনাল বর্ষের শিক্ষার্থী উসমান যেমন বলেন, “আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বলিনি যে আমি বাঙালি। সে কথা জানলে আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো। আমরা নিজের ভাষায় কথা বলতে পারি না। এটা যে কত বড় মানসিক যন্ত্রণা, বলে বোঝানো কঠিন। আমার কথাবার্তা শুনে কেউ বুঝবে না যে আমি আসলে বাঙালি। আমার মাতৃভাষা ও বাঙালি পরিচয় গোপন রাখতে পারলে তবেই একমাত্র আমার পক্ষে জীবনে দাঁড়ানো সম্ভব। যে মুহূর্তে আমি বলব আমি বাঙালি, আমার বিরুদ্ধে খোঁজখবর নেওয়া, তদন্ত করা শুরু হয়ে যাবে।

উসমান মনে করেন, বাঙালি হওয়া এখানে একটা অপরাধ। অকপটে স্বীকার করেন, আমাদের অগ্রজরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য কিছু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেসব খুবই নগণ্য। আমাদের সাহায্য করার জন্য কেউকেটা কেউ নেই। কোনো দপ্তরে উঁচু পদে কেউ নেই। সমাজের অভিজাত শ্রেণিতে কেউ নেই। এ ছাড়া আপনার যদি কার্ড না হয়, তাহলে আপনাকে তো আসল পরিচয় গোপন করতেই হবে। না হলে আপনি চাকরি জোগাড় করবেন কীভাবে, জীবনে এগোবেন কীভাবে?

তবে এ কথাও বলতে দ্বিধা করেননি উসমান, আমি তো আমার মাতৃভাষা, আমার পিতৃপরিচয় গোপন করে জীবনে এগোতে চাই না। আমি যে বাঙালি, সেটা আমি গোপন করতে আসলে চাই না। আমি উর্দু বলি, আমি পাকিস্তানি। কিন্তু আমি যে বাঙালি, সেটা আমি কিন্তু গোপন করতে চাই না। আক্ষেপের স্বরে উসমান বলেন, ইমরান খান বলেছিলেন, আমাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। মৃত্যু পথযাত্রী তৃষ্ণার্ত মানুষ পানি দেখলে যেমন বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তেমনি আমাদের মধ্যেও তিনি একটা আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর ব্যাপারটা সবাই ভুলে গেছে। আচ্ছা, বাঙালি গোষ্ঠীর কোনো মানুষ কি কখনো পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়েছে? কেউ কি পাকিস্তানে বাস করে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছে? তাহলে কেন আমরা এখানে মাথা উঁচু করে আর পাঁচজনের মতো থাকতে পারছি না?

হানিফের দেশে ফিরতে চাওয়া আর উসমানের পরিচয় গোপন করে বেঁচে থাকার কষ্ট হয়তো একদিন না একদিন কেউ না কেউ বুঝবে, সেই স্বপ্নে কাঁটাতার নাই-বা থাকল।

Link copied!