• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

প্রয়াণদিবসে লাকী আখান্দকে নিয়ে স্মৃতিচারণা


হাসান শাওন
প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৩, ১১:৩৭ এএম
প্রয়াণদিবসে লাকী আখান্দকে নিয়ে স্মৃতিচারণা

হয়তো তার পরনে ‘নেমেসিস’-এর টি-শার্ট। লম্বা চুলে হয়তো সাদৃশ্য আর্টসেলের লিংকনের। কাঁধের গিটারটাও এ তরুণ ধরে হয়তো বেজবাবা সুমনের মতো। এর সবই হয়তোর আলাপ। কিন্তু এমনদের নিয়ে একটা কথা নিশ্চিত, তা হলো, এদের অধিকাংশের জীবনে গিটারে তোলা, গাওয়া প্রথম দিকের গানের মধ্যে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ থাকবেই। সত্তরের দশকে ছোট ভাই হ্যাপিকে দিয়ে গাওয়ানো ‘ঘুড্ডি’ হয়ে ওড়া এ গানের কম্পোজার একজন লাকী আখান্দ। বাংলা গানের প্রবাহিত ধারায় যাকে উপেক্ষা এখনো অসম্ভব।

২০১৭ সালের আজকের দিনে বরেণ্য সংগীত ব্যক্তিত্ব লাকী আখান্দ অনন্তলোকে পাড়ি জমান।

জীবন ‘নীলমণিহার’ হয় তখন, যখন এই লাকী আখান্দের সঙ্গে এক টুকরো হলেও ব্যক্তিগত স্মৃতি থাকে। তখন ২০০৬ সাল। আমি সমকালের ফিচার বিভাগের কন্ট্রিবিউটর। একটি অনুলিখনের জন্য লাকী ভাইয়ের আরমানীটোলার বাসায় যাই। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীন দেশে একটা অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড গড়ে তুলবেন, এমন স্বপ্ন তার। যা আজ পর্যন্ত কেউ বাস্তব করতে পারেননি (নানা বাহিনী বাদে)।

তার ‘মামুনীয়া’ গান তো বিটিভিতে ছোট থেকে দেখে আসছি। বড় হতে হতে শুনতে শুনতে টের পাই অন্য সব গানের চেয়ে ওনার কম্পোজিশনের পরিচ্ছন্নতা। আমাদের স্কুলবেলায় পুরো বাংলাদেশ একবার রঙিন হয়েছিল। সেটা ছিল ক্রিকেটে আইসিসি ট্রফি জেতার দিন। আশ্চর্য হচ্ছে ৭১-এর মতো বাঙালির সে বিজয় বার্তাও দেশে পৌঁছে বেতার মারফত। এরপর আমাদের সবচেয়ে বড় উল্লাস ছিল বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর। ওই বিশ্বকাপের সময় ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ’ নামে অসাধারণ একটা গান করেন লাকী আখান্দ। স্কুলে থাকতে থাকতেই ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ ক্যাসেটটা হিট হয়। মিক্সড অ্যালবামের যুগ তখন। উল্টো পাল্টে ‘এ-পিঠ’ ‘বি-পিঠ’ সবই দারুণ লাগে। গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরী, গীতিকবি গোলাম মোর্শেদ আর লাকী আখান্দ জুটির অনন্যতা সব দিকে। সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান—যার ফ্যান যেই হোন; সবার ভালো লাগবে।

সেই লাকী আখান্দের অ্যাসাইনমেন্টে যাচ্ছি। খুব শিহরিত লাগে। সমকালের বিনোদন পাতার মিউজিক বিটে তখন কাজ করতেন জাকারিয়া শৌখিন, পাভেল আহমেদ, কবি সোমেশ্বর অলি ও রঞ্জু চৌধুরী। আমরা সবাই বন্ধু। সবাই তখন কন্ট্রিবিউটর। দুপুরে ভাত খাওয়ার টাকা না থাকলে কলা-পাউরুটি খাই শহীদ ভাইয়ের দোকানে। প্রয়াত সাংবাদিক তখনের ফিচার এডিটর গোলাম ফারুক ভাই যোগ দিতেন আমাদের সঙ্গে। আমার কন্ট্রিবিউটর বন্ধুরা আগে থেকে সতর্ক করে। কোনো খারাপ কিছু না। শুধু এটা বলে যে, লাকী ভাই কোনো মিডিয়াকেই পাত্তা দেন না। আমি রাজনৈতিক সাময়িকী ‘জনমঞ্চ’ এ কাজের সুবাদে তখন বেশ কিছু শীর্ষ পলিটিশিয়ানের অ্যাসাইনমেন্ট করে ফেলেছি। আমার মধ্যে মুই কি হনু ভাব। বোল্ডলি ফোন দিই লাকী আখান্দের টিঅ্যান্ডটি নম্বরে। অনেকক্ষণ বাজে। কিন্তু কেউ তোলেন না। তারপর নাম মনে নেই, কার কাছ থেকে যেন ওনার সেলফোন নম্বর পাই। সেখানে কল দিই। টেক্সট পাঠাই। একই পরিণতি। আমার তখন লাকী আখান্দের জন্য ‘নীলিমায় দুটি চোখ ভাসিয়ে দিয়ে পথ চেয়ে থেকো’ ছাড়া কিছু করার থাকে না।

দুই-তিন দিন পর লাকী ভাইয়ের নম্বর থেকে ফোন আসে। ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে কল রিসিভ করি। উনি খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলেন, ‘শাওন, তুমি ফোন দিয়েছিলে? আমি স্টুডিওতে ছিলাম। তাই ধরতে পারিনি। সরি!’ এসএমএস দেখে উনি আমার নাম মনে রেখেছেন দেখে আশ্চর্য বিনয়ী মানুষ মনে হয় ওনাকে। আমি বিস্তারিত বলি। তিনি আরমানীটোলার বাসার অ্যাড্রেস দেন। চলে আসতে বলেন। পরদিন রওনা দিই। সাদেক হোসেন খোকার বিশাল বিশাল পোস্টার দেখতে দেখতে পুরোনো শহরে প্রবেশ করি। আরমানীটোলায় আগে আসিনি। বাসা খুঁজতে একটু দেরি হয়। পৌঁছে দেখি একটা ভাঙা স্টেশন ওয়াগনের সামনে লাকী আখান্দ দাঁড়ানো। অফিস যাওয়ার ফরমাল ড্রেসে তিনি। স্পন্দিত বুকে আমি তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করি। লাকী ভাই খুব নির্বিকারভাবে বলেন, “শাওন, তুমি দেরি করেছ। এখন রেডিও অফিস যাব। তুমি কাল সেখানে আসো।” এই বলে তিনি ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেন। আমি দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখি। বন্ধুদের কথা মনে পড়ে—লাকী আখান্দ মিডিয়া পাত্তা দেন না।

পরদিন গেলাম শাহবাগ রেডিও অফিসের গেটে। বেলা ১১টার মতো বাজে। তীব্র উত্তেজনায় ভুগছি আগের দিনের কথা ভেবে। আজও কি মিস হবে? আবার রেডিও অফিস তো খুব রেস্ট্রিকটেড এরিয়া। এর নিচতলা ফিল্ম আর্কাইভ তখন। কী হবে? আমি ফোন দিই। লাকী ভাই ৫ মিনিটের মধ্যে তার সেই স্টেশন ওয়াগন চালিয়ে আসেন। আমাকে বলেন, ওঠো। আমি ড্রাইভিং সিটের পরে তার পাশে বসি। গেট বন্ধ করতে যাই। তিনি বলেন, এই গাড়ির গেট তুমি বন্ধ করতে পারবে না। তিনি নিজে গেট বন্ধ করেন। অবাক লাগে যে, এত বিখ্যাত একজন মিউজিশিয়ান (যাকে নিয়ে অঞ্জন দত্ত গান করেন) এমন সস্তা ভাঙা গাড়ি ইউজ করেন দেখে।

লাকী ভাই ফার্মগেটের দিকে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই আমার সঙ্গে কথা বলেন। এরপর রেকর্ডার অফ করলে নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন ভীষণ সরল গানের সরল এই মানুষ। অবাক হতে থাকি বিন্দুমাত্র স্টারডমহীন লাকী ভাইকে দেখে। একসময় জানতে চাইলাম ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান তো লিখেছি’ এই গানের গল্প। লাকী ভাই বলেন, “দেশ স্বাধীনের পর ভোররাতে একবার শহীদ মিনার এলাকায় গেলাম। দেখলাম অনেক মানুষ ঘুমাচ্ছে বেদিতে। তখন মনে হলো, শহীদ মিনার তো ঘুমের জায়গা না। মানুষ এখানে ঘুমায় কেন? তখন সুরটা মাথায় এসেছে। আর কাওসার লিরিক লিখেছে।” উনি কোনো জটিলতার মধ্যে নেই। সব কিছু সহজভাবে চিন্তা।

লাকী ভাইয়ের কথার অনুলিখন প্রকাশিত হয় সমকালে। আমি ওনাকে ফোন দিই। পত্রিকা নিয়ে দেখা করতে চাই। আমার ইচ্ছা এবার আরমানীটোলা বা ওনার স্টুডিওতে যাওয়ার। উনি কীভাবে গান কম্পোজ করেন তা সরাসরি দেখা। লাকী ভাই ফোন ধরেন। বলেন, “পত্রিকা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি পরে দেখব। এখন বিজি।” বলে ফোন কেটে দেন। অসম্ভব খেয়ালী মানুষ মনে হয় ওনাকে। একই সঙ্গে যিনি সব রকম রাখঢাকের বাইরে। আর তা প্রকাশেও সাবলীল।

নানা কারণে লাকী ভাইয়ের সঙ্গে এরপর দীর্ঘ যোগাযোগহীনতা। কিন্তু তাকে নিয়ে অপার শ্রদ্ধা ও গুণমুগ্ধতা কাটেনি এতটুকু। ২০১২ সালে বণিক বার্তায় কর্মকালে আবার একটু লাকী ভাইয়ের দেখা পাই। সম্ভবত কোনো বিজয় দিবস সংখ্যার কাজে। সেবার দেখা হয় ময়মনসিংহে। তখন আমাদের স্কুল বন্ধু ও প্রথম আলোর সাবেক কন্ট্রিবিউটর সাজিদ আখন্দ ত্রিশালে সেটেল। আমরা সুযোগ পেলেই সেখানে যেতাম। অনেক বন্ধু মিলে যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আর ময়মনসিংহ শহরে। ব্রহ্মপুত্রপাড়ের শহীদ বিপিণ পার্ক আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রচুর আড্ডা হতো। সবুজ ঘাসে হাত পা ছড়িয়ে ফুচকা খেতাম নদীর পাশের ‘সারিন্দা রেস্টুরেন্ট’-এ। এ রেস্টুরেন্টটা বোধ হয় এখন নেই। 

লাকী ভাই তখন মুক্তাগাছা বেড়াতে যাবেন। উঠেছেন ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে। বললেন, চলে আসো। বহু বছর পর আলিঙ্গন করি লাকী ভাইকে। সেই স্টেশন ওয়াগনটাই দেখি মামন্তি (লাকী আখান্দের মেয়ে) চালাচ্ছেন বিশাল মাঠের অন্ধকারে। লাকী ভাই ব্যস্ত ছিলেন। মুডে ছিলেন না কথার। বেশিক্ষণ তাকে পাই না। লেখাটাও অসমাপ্ত থেকে যায়। আর জানাও ছিল না এই শেষ দেখা। 

শুনেছি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর শেষ সময় পাহাড়ে গিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন লাকী ভাই। থাইল্যান্ডের ডাক্তারই মূলত তাকে বলেছিলেন পাহাড়ের বিশুদ্ধ হাওয়া নিতে। বন্ধুবর রাজা দেবাশীষকে তিনি বলেছিলেন পাহাড়ে গিয়ে থাকার ইচ্ছার কথা। একটা পাহাড় কেনারও শখ ছিল তার। সেখানে প্রকৃতির মাঝে বসে গান করবেন কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে, এই ছিল তার বাসনা।

এখন পাহাড়ের চেয়েও অসীম উচ্চতায় লাকী ভাই। সে অনন্তলোকে সঙ্গী আছেন একই সময়ে গ্রহচারী সারথি গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরীও। সুরের কম্পনমাত্রা দিয়ে মানুষকে জীবনজুড়ে মুগ্ধতা দিয়েছেন যারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুহূর্তে মুহূর্তে আন্দোলিত হয় যে গেরিলা যোদ্ধা আর শব্দ সৈনিকের সৃষ্টিতে। যারা মিডিয়াকে শুধু না, কোনো পদ, পদবি, পদকের জন্য সৃষ্টিরত ছিলেন না। লালসার ক্ষুধার বাইরে সন্ত হয়ে শুধু্র মানুষের একান্ত বেদনার উপশমে যাদের নিমগ্ন প্রহর কেটেছে।

১৯৫৬ সালের ৭ জুন ঢাকায় জন্ম নেওয়া শিল্পী লাকী আখান্দের পরিবার তার সব গানের রয়ালিটি পাচ্ছেন তো? ২০১৯ সালে যে শিল্পীর জন্মদিনে গুগল নতুন ডুডল প্রকাশ করেছিল, তিনি স্বভূমি ও স্বভাষায় সসম্মানে আছেন কি? প্রয়াণ দিবসে এসব প্রশ্নের উত্তর জরুরি হয়ে উঠে আসা অসংগত নয়।

Link copied!