• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

নীলুফার ইয়াসমিন : বিস্মৃতপ্রায় এক শিল্পী


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩, ০৮:৫১ এএম
নীলুফার ইয়াসমিন : বিস্মৃতপ্রায় এক শিল্পী
নীলুফার ইয়াসমিন

কথিত আছে, মাকসুদ বাংলা ভাষাকে ‘ক্ষ্যাত’ বলে আজম খানের হাতে শাসনের চড় খেয়েছিলেন। সে রকম চড় মারা উচিত আমাদের, আমরা ভাবি পুরাতন বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলাদেশের গান সবই ‘আনকুল’। পুরোনো দিনের গানের কোনো সৌন্দর্য আমরা খুঁজে পাই না এই বাংলার। ঢাকাতেও ভালো গান কম বেশি হয়েছে মনে রাখার দরকার হয় না। সে রকম একজন ভুলে যাওয়া শিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন।

কয়েক দিন আগে বসে গাচ্ছিলাম গুনগুন করে, ‘এত সুখ সইবো কেমন করে?’ এক ছোটভাই মজা করে বললো, ‘শান্ত ভাই পুরো রেট্রো যুগে থাকেন।’ পোলাপান মানুষ তাদের বোঝানো যায় না, নব্বইয়ের মতোই সেভেন্টিজ এইটিজও অনেক চমৎকার সব কাজ হয়েছে।

নীলুফার ইয়াসমিন বাংলাদেশের বিরলপ্রজ শিল্পী, যারা মূলত গানকে একটা শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপার ভাবতেন। নিজেও দীর্ঘদিন প্রভাষক জীবন কাটিয়েছেন। কাজ করেছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির নাট্যকলা ও সংগীতে। রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা জানাচ্ছেন, এত নিবিষ্ট হয়ে তিনি আর কাউকে গান শেখাতে দেখেননি ঢাকায়। তিনি নিজেও গান শিখেছেন পিসি গোমেজ থেকে শুরু করে মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত মহীরুহদের কাছে। একুশে পদক প্রাপ্ত সঙ্গীতজ্ঞ ও নজরুল গবেষক সুধীন দাশ বলেছিলেন, তিনি আনন্দ পান যে কিছুদিন তিনি নীলুফারকে গান শেখাতে পেরেছিলেন।

সাবিনা ইয়াসমিন অথবা নীলুফার ইয়াসমিনের কিংবা ফওজিয়া ইয়াসমিনের বড় শিল্পী হবার অন্যতম বড় কারণ তাদের মা। ভদ্রমহিলা সময় পেলেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতেন। নিয়ম করে গানের টিচার রাখতেন। সরকারি কর্মচারীর বড় এক পরিবারে সেই পাকিস্তানি আমলেও গান বাজনা করা কত বিলাসিতা তা সহজেই অনুমেয়। নীলুফার ইয়াসমিনের ছোটবেলার অদ্ভুত মায়া লাগা কিছু ছবি আছে গুগলে। পড়াশোনাতেও ছিলেন ভালো। ঢাকা ভার্সিটি থেকে এমএ করেছেন বাংলাদেশ স্বাধীনের আগেই। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, অতুল, ডি এল রায়, টপ্পা, রজনীকান্ত সেন, খেয়াল, ঠুমরী সব গান গাইতে পারতেন নির্ভুলভাবে। বাংলা সিনেমাতেও গান গেয়েছেন, তবে তিনি সিনেমার প্লেব্যাক হিট শিল্পী হতে চাননি। যে গান পছন্দ হতো শুধু সেই গানটাই গাইতেন।

এবার বলি তার সবচেয়ে সুন্দর গানটা গাওয়ার গল্প। ‘শুভদা’ সিনেমার জন্য গানটা সাবিনা ইয়াসমিনকে গাওয়াতে রেডি। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের কথা ও খন্দকার নুরুল আলমের সুর। সাবিনা গানটি গাইতে অনিচ্ছুক, অত্যন্ত কঠিন গান। সিনেমার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সাবিনাই অনুরোধ করেন, এই গানটা একমাত্র নীলা আপাই গাইতে পারবেন। নীলুফার ইয়াসমিন শুনে জানতে চাইলেন আমি আগে রেডি হই। চার দিনে তিনি প্রস্তুত হয়ে এরপর রেকর্ডিং করলেন। তৈরি হলো কালজয়ী গান, ‘এত সুখ সইবো কেমন করে?’

অবশ্য আমার আম্মুর কাছে নীলুফার ইয়াসমিনের প্রিয় গান হলো, ‘জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু’। এছাড়া আমার আরও কয়েকটা পছন্দসই গান হলো, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’, ‘এ আধার কখনো যাবে না’, ‘আমাকে তুমি ভুলে গেছ’। তাঁর গাওয়া নজরুল সংগীতগুলোও গতানুগতিক নয়। খুবই সমর্পণ করে গাওয়া। তিনি অকালেই চলে গেছেন- শিশিরবিন্দুর মত, ক্যান্সারে। ক্যামোথেরাপি দিয়ে এসেও তিনি সিডি বের করেন, সেই মোড়ক উন্মোচনেও তিনি খুবই নম্রতার সঙ্গে জানাচ্ছিলেন, “আমি খুবই অসুস্থ। তাও এখানে গান গাইবার লোভ সামলাতে পারলাম না।”

চলে গেছেন কুড়ি বছর আগে, ২০০৩ সালে আজকের দিনে। বিনম্র শ্রদ্ধা বাংলা গানের এই কিংবদন্তিকে।

Link copied!