‘পেত্রাতে বেশি বেশি ছবি তুলবে’—এ রকমটাই বলছিল পরিবার ও বন্ধুরা। তাই তো! জর্ডান মানেই তো পেত্রা , সেই ছেলেবেলা থেকেই জেনে আসছি। কিন্তু জর্ডানে পা রেখেই বুঝেছি , এর প্রতি ইঞ্চিতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। ভ্রমণকারীদের জন্য এই ভূখণ্ড তো স্বর্গরাজ্য, বিশেষ করে যারা ইতিহাস-ঐতিহ্যের পথ ধরে হাঁটতে চান। অথচ ১০০ বছর আগেও জর্ডান নামে পৃথিবীর মানচিত্রে কোনো দেশই ছিল না।
ভ্রমণ গল্প শুরুর আগে সেই ইতিহাস ছোট্ট করে একটু বলি—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৌদি আরব, জর্ডান, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল ইত্যাদি দেশ ছিল। সব মিলিয়ে আরব ভূখণ্ড অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জর্ডান নদীর পূর্ব তীরে এই আরব ভূমিকে বলা হতো ট্রান্সজর্ডান। ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) পর্যন্ত সমস্ত আরব ভূখণ্ডকে বলা হয় লেভান্ত। ট্রান্সজর্ডান এলাকায় জনপদ ছিল ব্রোঞ্জ যুগ থেকে। সে জন্য এই ভূখণ্ডের পথে পথে ইতিহাস ছড়িয়ে আছে।
এবার ভ্রমণ গল্পে ফিরি—মাদাবা শহর যাওয়ার আগ অব্দি পেত্রা দেখা হয়নি। আম্মান আর জেরাশ শহর ভ্রমণ করেই আমি বাক্হারা। গত দুই দিন উত্তরে ভ্রমণ করেছি। উত্তরে ভ্রমণ করবার সময় গাইড ইয়াসির বলছিল, “জর্ডানের সবুজ ভূখণ্ড বলা হয় উত্তর জর্ডানকে। তাই বেশি করে সবুজ দেখে নাও। কাল থেকে আর সবুজ দেখতে পাবে না।” শুধু তা-ই নয়, উড়োজাহাজ আম্মান শহরে ল্যান্ড করার সময়ও ওপর থেকে দেখছিলাম, চারদিকে সবুজের ছিটেফোঁটা নেই, কেবল পাথরের পাহাড় আর বালু। যত দূর মনে পড়ছে মিসরেও এমনটা দেখিনি। যদিও সেখানে বছরে সিকি ভাগ বৃষ্টিপাত হয় না।
আজ দক্ষিণে ভ্রমণ শুরু। কমতে শুরু করেছে সবুজ। আমাদের মাইক্রোবাস ছুটে চলছে মাদাবা অভিমুখে। মাদাবা বিশ্বপর্যটকদের কাছে মূলত পরিচিত বাইজেন্টাইন সময়ের একটি মোজাইক ম্যাপের জন্য। সকাল সাড়ে আটটায় রওনা করেছি তাই রাস্তা বেশ ফাঁকাই রয়েছে। মূল শহর ছেড়ে যাচ্ছি, ক্রমেই জনবসতি কমছে। বেশ কিছু দূর যেতেই আমরা কিংস ওয়েতে উঠলাম। গাইড ইয়াসিরকে আগেই বলে রেখেছিলাম কিংস ওয়ের কথা। গাইড অবশ্য বলেছিল পেত্রা থেকে ওয়াদি রাম যাওয়ার পথেও ‘কিংস ওয়ে’র দেখা মিলবে। আবার ইতিহাসে প্রবেশ করতে হচ্ছে। উপায় নেই ! কেন কিংস ওয়ে দেখবার জন্য আকুল ছিলাম, বলছি সে কথা–পথের নাম কিংস ওয়ে।
কিংস ওয়েতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে, গাইড ইয়াসির বলল, "Eliza this is your King`s way, you asked for...!” কিছু কিছু পথ দেখলাম চার লেনের। আগে নিশ্চয়ই এ রকম ছিল না। নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। ঐতিহাসিক এই পথকে পুরাতন সিল্করোডও বলা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব হাজার হাজার বছর হতে মধ্যযুগে এমনকি বিংশ শতাব্দীর আরব বিদ্রোহের ঐতিহাসিক জায়গাগুলো রয়েছে, এই রাস্তার দুধারে। কিংস ওয়ে তোরাহ, ওল্ড টেস্টামেন, বাইবেল ও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত বহু পয়গম্বরের পদধূলিতে পবিত্র বলে পরিগণিত। একদম ইতিহাসের খোলা পাতার মতো।
প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম বসতি থেকে প্রস্তর যুগ, ক্রুসেডার ক্যাসেল, বাইজেন্টাইন মোজাইক, রোমান হারডিয়ান দুর্গ, নাবাতায়েন ও ইসলামের বহু নিদর্শন দেখতে এই রাস্তাই ব্যবহার করতে হবে। তাই জর্ডানে আগত, যেকোনো পর্যটকেরই এই রাস্তার সাথে পরিচয় ঘটবে। কিংস ওয়ে অল্ড টেস্টামেন ও বাইবেলে বর্নিত হয়েছে। হযরত মুসা অনুসারীদের নিয়ে ইডমের প্রান্তর দিয়ে যখন উত্তরে গিয়েছিলেন, এই কিংস ওয়ে ব্যবহার করেছিলেন। ধর্মীয় ইতিহাস পাঠে জানা যায়, এই পথ হজরত মুসার আগেও ব্যবহার হয়েছে। জর্ডানের উত্তরের চার রাজা ও দক্ষিনের পাঁচ রাজার শহরে যুদ্ধ করতে এ পথ ব্যবহার করেছিলেন। সে সময় আগ্রাসী রাজারা হযরত ইব্রাহিম ( আ.)-এর ভাতিজা লুতকে (আ.) বন্দী করেছিলেন। এ ঘটনা ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। ঐতিহাসিক বিবলিক্যাল এবং কোরআনে বর্ণিত এই পথে যাচ্ছি, নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না।
তারপর ধীরে ধীরে কিংসওয়ে ছেড়ে মরু রোডে এলাম। বাইবেলে বর্ণিত হলিল্যান্ড মাদাবার একেবারে কাছে চলে এসেছি। লোকালয় বাড়তে থাকল। বেশ ছোট ছিমছাম শহর। স্থানীয় লোকজন দোকানপাটে রয়েছে কিন্তু পথে দেখতে পেলাম বেশ ট্যুরিস্টদের আগাগোনা।
আমাদের মাইক্রোবাস মাদাবা চার্চের কাছে এসে থামল। উঁচু দেয়াল ঘেরা লোহার একটি ফটকের সামনে এসে ইয়াসির হাতের ইশারায় পথ দেখাল। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে ইয়াসির এই স্থানের ইতিহাস বলছিল একসময় এখানে ছোট ছোট গীর্জা ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সময়ে ছোট ছোট মোজাইক দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল যিশুখ্রিষ্টের অবয়ব ও তাঁর জীবনের অনেক অধ্যায়। এখনো মাদাবাতে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করার জন্য খনন করলে পুরোনো মোজাইকের মেঝে পাওয়া যায়। জর্ডান সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়েছে, কারও জমিতে এ রকম কোনো প্রত্নস্থলের সন্ধান পাওয়া গেলে, সেটি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে এবং সরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে।
আমরা এসে পৌঁছেছি দ্য চার্চ অব সেন্ট জর্জের চত্বরে। এই চার্চের ভেতরে একটি মোজাইক পাওয়া গেছে, যার নাম ম্যাপ অব প্যালেস্টাইন। এটি ষষ্ঠ শতাব্দীর ম্যাপ। যেখানে ইসরায়েলের নাম নেই। অথচ ইসরায়েল তাদের রাষ্ট্রকে বিবলিক্যাল রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করে থাকে।
গির্জার সামনে বড় একটি ওকগাছ। গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার স্থাপত্যশৈলীতে বানানো। ওকগাছের ছায়ায় অপেক্ষা করছি। গির্জার ভেতরে একসঙ্গে অনেক ট্যুরিস্ট প্রবেশের অনুমতি নেই। একটি দল বের হওয়ার পর অন্য দল প্রবেশ করবে। মিনিট ১৫ পর ইয়াসির বলল, এখন আমাদের সময় আমরা প্রবেশ করতে পারব।
ভেতরে প্রবেশ করে বুঝলাম কেন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গির্জাটি পরিভ্রমণ করতে হয় । ভেতরে স্থান সংকুলান কিছুটা কম। দেয়ালজুড়ে ধর্মীয় নানা চিত্রকলা আঁকা রয়েছে। কয়েক সারি কাঠের ফ্রেঞ্চ বেঞ্চ পার হওয়ার পরই মোজাইকটি চোখে পড়বে।
এই ম্যাপটি তৈরি করতে দুই মিলিয়ন ছোট ছোট রঙিন মোজাইক ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গা ক্ষয়ে গেছে। খ্রিষ্টান তথা ইহুদিদের জন্য হলিল্যান্ড নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের জন্য এই ম্যাপটি একটি অন্যতম বা বলা যায় একমাত্র ঐতিহাসিক সূত্র।

ম্যাপটির সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে ইয়াসির বলল, হলিল্যান্ড বলতে প্যালেসটাইন বোঝানো হচ্ছে। একটি নীল রঙের সরু রাস্তার মতো দেখা যাচ্ছে, এটি হলো দক্ষিণের সীমানায় জর্ডান নদী, মাঝে ডেড সি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দুটি শহরের অবস্থান, জেরিকো ও বেথেলহাম। এই দুই শহরের মাঝামাঝি জেরুজালেম। ডেড সি যেখানে অঙ্কিত রয়েছে, সেখানে দুটি মাছের অবয়ব রয়েছে, যারা ডেড সি থেকে জর্ডান নদীর দিকে যাচ্ছে। কারণ ডেড সিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য মাছ বেঁচে থাকতে পারে না। গির্জার বেদির কাছে মানচিত্রের কেন্দ্রে থাকা জেরুজালেমকে দেখানো হয়েছে গ্রিক ভাষায়। জর্ডান নদীতে মাছের সাঁতার কাটার ছবি এবং মৃত সাগরে নৌকার ছবি এত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ না করে উপায় নেই। ইয়াসির বারবার একটি কথাই বলছিল, “এখানে ইসরায়েল বলে কোনো স্থান নেই, পুরোটাই প্যালেসটাইন ভূখণ্ড।”
সেই ভূখণ্ডের সেই সময়ের ৩৮টি গলি ও চার্চ অব হোলি স্পুলচার। ধারণা করা হয়, রোমানরা এখানেই হজরত ঈসা বা যিশুখিষ্টকে ক্রুশে দিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। ওই সময়ে তাঁর দেহ নামিয়ে সাদা চাদরে ঢেকে এখানে (জেরুজালেমের সেই গির্জার স্থানে) গুহাতে রাখা হয়েছিল সারা রাত পাহারা ছিল, কিন্তু পরদিন যিশুর কাপড় ছাড়া শরীর পাওয়া যায়নি।
মোজাইক ম্যাপের পশ্চিম প্রান্তে লোহিত সাগর আর পূর্ব প্রান্তে সি অব গ্যালিলি। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন জায়গার হ্রদ। ম্যাপের উত্তরে ভূমধ্যসাগর। এটাই তৎকালীন ফিলিস্তিনের ম্যাপ। ব্রোঞ্জ যুগে এ অঞ্চলের নাম ছিল মোবাতা। রোমান-বাইজেনটাইনদের ঘুরে উমাইয়া শাসনের সময় এ শহর আরব প্রদেশের অংশ হয়।
ঘণ্টাখানেকের জন্য মনে হচ্ছিল পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে চলে গিয়েছিলাম। ম্যাপ দেখা শেষ করে আমি গির্জার ভেতরের চারপাশ দেখতে আরম্ভ করলাম। ইয়াসির তাড়া দিচ্ছিল, বাইরে আরও ট্যুরিস্ট অপেক্ষা করছে। মোজাইক ম্যাপটি যেন দেখা শেষই হচ্ছিল। গির্জা থেকে বের হওয়ার সময় পেছন ফিরে আবারও একবার ম্যাপটি দেখে নিলাম।
মোজাইক ম্যাপটিকে ঘিরে এই চার্চ নির্মাণ করা হয় ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। আম্মান শহর থেকে মাদাবার দুরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এর পরের গন্তব্য ক্রুসেডার ক্যাসেল ও মাউন্ট নেবু । জানি না সেখানে আরও কত রহস্য ও ইতিহাস অপেক্ষা করছে।
লেখক : ঐতিহ্য পর্যটক ও শিক্ষক
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































