• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
কাতার বিশ্বকাপ

আজ তবু হেসে যাও, বিদায়ের দিন তবু কেঁদো না


সৌরভ কুমার দাস
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২২, ০২:৫২ এএম
আজ তবু হেসে যাও, বিদায়ের দিন তবু কেঁদো না
ছবিঃ সংগ্রহীত

‘হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারাজীবনের বেদনা। আজো তবু হেসে যাও, বিদায়ের দিন তবু কেঁদো না। ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না’ কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতাটা কোনো না কোনো ভাবে আজ প্রত্যেক রোনালদো ভক্তের মনের কোনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। রোনালদো অবশ্য পারেননি। না পেরেছেন বিদায় বেলা রাঙাতে, না পেরেছেন নিজেকে সামলাতে।

রেফারি শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়েছে পর্তুগালের। না, শুধু পর্তুগালের বিদায় নয়, একই সাথে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামক ফুটবল নক্ষত্রও যেন বিশ্বকাপের আকাশ থেকে খসে পড়লো মাটিতে।

পর্তুগালের বাকি খেলোয়াড়রা তখন রেফারির সঙ্গে তর্ক যুদ্ধে ব্যস্ত, কেউ কেউ মাঠেই বসে পড়েছেন হতাশায়। আর অন্যদিকে একজন মানুষ চেষ্টা করছেন যত দ্রুত সম্ভব সবুজ ঘাসের মাঠটা ছেড়ে যাওয়া যায়, চেষ্টা করছেন যত দ্রুত সম্ভব সব আলো থেকে ড্রেসিংরুমে চলে যাওয়া যায়।

তবে তিনি যত দ্রুতই যাওয়ার চেষ্টা করেন না কেন, ক্যামেরার লেন্স যেন তার থেকেও কয়েক গুন গতিতে ছুটতে লাগলো তার পিছনে। কেনইবা পিছু নেবে না বলুন তো!

এই তো শেষবার! এবারই তো শেষবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বিদায় নিচ্ছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামে ফুটবলের এক ধ্রুবতারা। তার শেষবারের মতো বিদায়ের কঠিন রাস্তা টুকু ক্যামেরা বন্দি করার এই তো শেষ সুযোগ। সেই সুযোগ কেউ কেন হাতছাড়া করতে চাইবে।

তবে রোনালদো  কেন এত দ্রুত যেতে চাইলেন, সেটা বোঝা গেল টানেলে ঢোকার পরই! আর পারলেন না। যেটা চেয়েছিলেন সেটা হলোই না। টানেলে ঢোকার পর আর কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারলেন না। না পারাটাই তো স্বাভাবিক, মাঠে যতই অন্য গ্রহের প্রাণীর মতো পারফর্ম করেন না কেন, তিনি তো আদতে বাকি সবার মতো রক্ত-মাংসের একজন মানুষই।

টানেলে ঢুকেই সবার আগে হাত দিলেন চোখে! সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন যেন চোখ অনবরত ঝড়তে থাকা ওই অশ্রু বাইরের কেউ না দেখে! কিন্তু পারলেন কই, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পরিষ্কার হয়ে গেলো, কাঁদছেন রোনালদো! আমি নিশ্চিত ম্যাচের আগেও রোনালদোর সমালোচনা করেছেন, এমন একজনও যদি এই দৃশ্যটা দেখেন তার চোখ দিয়েও নিজের অজান্তেই পানি ঝড়েছে।

লম্বা ক্যারিয়ারে কি জেতেননি রোনালদো? না, প্রশ্নটা এভাবে না করে বলা ভালো, রোনালদোর আসলে জেতার বাকি আছে কি! হ্যাঁ, এখানে চট করে বলে দিতে পারেন বিশ্বকাপ জিততে তো পারেননি।

কিন্তু এই মানুষটাই জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবার চেয়ে বেশি গোল করেছেন। এই মানুষটাই একমাত্র ফুটবলার যার পাঁচ বিশ্বকাপে গোল রয়েছে। ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্যর চেয়েও অনেক বেশি সাফল্য পেয়েছে। তাকে শুধু একটা বিশ্বকাপ না জেতার জন্য আপনি ইগনোর করতে পারেন না।

আপনাকে এটাও মনে রাখতে হবে ফুটবল দলীয় খেলা, মাঠে থাকা বাকি ১০ জনেরও পারফর্ম করতে হয়। খুব কম সময়ে একা হাতে দলকে ম্যাচ জেতানো যায় এবং সেটা যে সম্ভব সেটাও কিন্তু এই রোনালদোই করে দেখিয়েছেন।

সময় বড্ড খারাপ যাচ্ছে, যিনি ফুটবলকে রীতিমতো কথা বলাতে পারতেন, সেটাই অনেকদিন ধরে বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছে। মাঠে নামলে আর আগের মতো খিপ্রতা দেখিয়ে গোল করতে পারছেন না। বিশ্বকাপে আসার আগে ক্লাবের একাদশে জায়গা হারিয়েছেন।

বিশ্বকাপে অবশ্য প্রথম তিন ম্যাচে শুরুর একাদশেই ছিলেন। কিন্তু শেষ ষোলোর ম্যাচে একাদশ থেকেও বাদ পড়লেন। শেষ ষোলোয় সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে পর্তুগাল অথচ সাইডবেঞ্চে রোনালদো, এমন দৃশ্য দেখে অবাক হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়াটা যেন সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠার মতোই অসম্ভব।

বাস্তবতা কত নিষ্টুর হতে পারে! যে পর্তুগালের ফুটবল ইতিহাস বলতে গেলে রোনালদো চলে আসে অবধারিতভাবে। সেই রোনালদোর জায়গা হলো সাইড বেঞ্চে, সেটাও পাক্কা দেড় যুগ পর।

ওই ম্যাচেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুইটি ছবি খুব আলোচিত হয়েছিল। প্রথমটি মাঠে থাকা পর্তুগাল দলের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক ক্যামেরার লেন্স ছিল সাইড বেঞ্চে বসে থাকা রোনালদোর দিকেই। আরেকটি বেঞ্চে বসে অসহায় মুখে পর্তুগাল কোচের দিকে রোনালদোর তাকিয়ে থাকা।

এমন দৃশ্যও সম্ভব। যে মানুষটার এগ্রেসিভনেস ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের রাতের ঘুম হারাম করে দিতো। যার চোখের দিকে তাকালে আগুন ঝড়তো, যেই লোকটা কখনোই কোথাও মাথা নীচু করেনি! সেই একই লোকটাই কি অসহায় মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে!

ওই দৃশ্য থেকে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে রোনালদো ভক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। ফুটবল প্রেমী বা তার সম্পর্কে টুকটাক ধারণা থাকলেও রোনালদোকে ওইভাবে দেখে মনের ভিতর উথাল-পাতাল ঝড় ওঠাই স্বাভাবিক। সময় আসলে খুবই নিষ্ঠুর, দয়ামায়াহীন।

যে লোকটা মাঠে থাকলে কোচরা নিশ্চিন্ত থাকতেন, সেই লোকটাকেই সাইডবেঞ্চে বসিয়ে রাখছেন তারা। তার জন্যও চারপাশ থেকে  বাহবাও পাচ্ছেন! হায়রে নিষ্ঠুর বাস্তবতা!

নিজেকে সেরা দাবি করেন, একাই গোল করতে চান, টিমম্যান নন এরকম কতশত অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নিন্দুকদের। তবে যতবারই নিন্দুকরা তাকে সমালোচনার শূলে চড়িয়েছেন, পরক্ষণেই আবার তার পারফর্মেন্সের প্রশংসা করতে বাঁধ্য হয়েছেন।

এই যে এত বড় ফুটবলার হয়েছেন, এত এত রেকর্ড গড়েছেন, কতশত গোল করেছেন, শিরোপা জিতেছেন। অথচ এই লোকটার পৃথিবীতেই আসার কথা ছিল না। অভাব অনটনে নিজেরাই দুইবেলা খেতে পান না, এর মধ্যে সন্তান পৃথিবীতে আসলে তাকে মানুষ করবেন কিভাবে, এসব চিন্তা করে রোনালদোকে পৃথিবীতেই আনতে চাননি মা-বাবা।

তারপরও হয়তো ঈশ্বর চেয়েছিলেন বলেই নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন। জন্ম হয়েছিল রোনালদোর। তবে বাবা-মা যা ভেবেছিলেন সেটাই হলো, ছোটোবেলা কাটলো ভয়ঙ্কর অভাবে!

এর মধ্যে আবার বাবাও চলে গেলেন স্বর্গলোকে!। এরপর মায়ের সঙ্গে কখনো রাস্তায় ঝাড়ুদার আবার কখনও অন্য কোনো ভাসমান কাজ করে পেট চালিয়েছেন। পর্তুগিজ ক্লাব লিসবনে খেলে নিজেকে চিনিয়েছেন।

সেখান থেকে পাড়ি জমিয়েছেন ব্রিটিশ মূলকে। ইংল্যান্ডের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলেছেন, নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন। এরপর তো স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে নিজেকে নিয়ে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের কাতারে।

ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে আসার আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিয়ে সাক্ষাৎকারে বোমা ফাটিয়েছিলেন। এরপর এটা নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্কের মুখে পড়েছেন। সেসব নিয়েই এসেছিলেন কাতারে।

চেয়েছিলেন শেষ বিশ্বকাপটা রাঙাবেন আপন রঙে! তবে সারাজীবন যে গোল আকৃতির ফুটবল তাকে দিয়েছে হাজারো অর্জন সেটা বিশ্বকাপেও থাকলো চুপ করে।

বিশ্বকাপ জিততে পারেননি এমন কিংবদন্তীদের তালিকাটা খুব একটা ছোট নয়।  ইয়োহান ক্রুইফ, ইউসেবিও, লুইস ফিগো, ডেভিড বেকহাম, সক্রেটিস, জিকো...আরও কত নাম! এবার সেই তালিকায় যোগ হলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।

তবে উপরের নামগুলোকে যেমন ফুটবল ভোলেনি, রোনালদোকেও তেমনি কেউই ভুলবে না। বলা ভালো, ভুলতে দিবে না। তাই বলা ভালো, প্রিয় রোনালদো, আপনি থাকছেন স্যার।

Link copied!