• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মাহিয়া মাহিকে নিয়ে কেন ট্রল হচ্ছে?


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৪, ০২:৪৩ পিএম
মাহিয়া মাহিকে নিয়ে কেন ট্রল হচ্ছে?

জয় বা পরাজয় যা-ই হোক, নির্বাচনের পরদিন শোডাউনের ঘোষণা দিয়েছিলেন রাজশাহী-১ আসনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি। সে কথা তিনি রাখেননি। না রাখাটাই স্বাভাবিক। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে উৎসবের আমেজে থাকা অনেকেই অনেক কথা বলেন। উৎসবের আমেজ কমে গেলে বা আলো ফুরিয়ে গেলে এক বিষণ্ণতাই কাজ করে। আর মাহিয়া মাহির তো শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। নির্বাচনে এই আসনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর কাছে পাত্তাই পাননি মাহি। 

মাহিয়া মাহির পরাজয়ের পর থেকে ফেসবুক গ্রুপে নানারকম ভিডিও নির্মাণ করছেন নেটিজেনরা। এসব ভিডিওতে মাহিকে নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে। এগুলোও মাহির নজরে এসেছে। এ বিষয়ে মাহিয়া মাহি বলেন, “এগুলো নিয়ে আর নতুন করে কী বলব। আমার অভ্যাস আছে। আমি ইউজড টু। ট্রল তো নিয়মিতই আমার সঙ্গে হয়। কিন্তু একটা কথা বলব, মানুষকে এভাবে ট্রল করা ঠিক না। একটা মেয়ে হয়ে নির্বাচন করেছি।”

মাহিয়া মাহির বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় নজরে আসবে। প্রথমত, তিনি চিত্রনায়িকা। বাংলাদেশের ফিল্ম জগতের বর্তমান অধিকাংশ অভিনেত্রীকেই ট্রলের শিকার হতে হয়। এই ট্রলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিল্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নারী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সনাতনী ধারণা। যদিও পূর্ববর্তী দশকের অনেক নায়িকাদের সঙ্গে সনাতনী নারীর ধারণা অধিকাংশ সময়েই জড়িয়ে দেখা হয়, তারপরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সময়ে তারাও আদৌ ট্রল এড়াতে পারতেন কি-না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে যথেষ্ট। ট্রল যে হয় না তা কিন্তু নয়। এখনও পুরোনো চলচ্চিত্রের কাটসিন অনেক ট্রল ভিডিওর খোরাক জোগায়। অনেক মিমেও অনেক নায়িকার ফিল্মি চরিত্রের বারবার আগমন। মানুষ ফিল্মের জগতেই নায়ক-নায়িকাদের রেখে ট্রল করেন। মাহিয়া মাহিও বাস্তবের মানুষ হলে কী হবে, তাকে আমরা রেখে দেই ফিল্মের ভেতর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে এখন যেহেতু তারকাদের জীবনের প্রতিদিনের আপডেট পাওয়া যায়, সেহেতু মানুষ তার বাস্তব জীবনকেও যাচাই করতে পারে। কিন্তু মানসিকভাবে ওই ফিল্মের প্রেক্ষাপটই নায়ক-নায়িকার পরিচয় হয়ে গেঁথে থাকে। নায়ক-নায়িকা যেই হোক এখনও পরিচিত হন ‘অমুক ফিল্মখ্যাত’ বলে। 

মাহিয়া মাহির পেশাগত অবস্থানও সেখান থেকেই। এমন ভাবনা যে শুধু আমাদের দেশে তা কিন্তু নয়। পশ্চিমা দেশেও অনেক তারকা রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাদের সম্পর্কে যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মানুষের মনে যে অমন ধারণা ছিল না বা কাজ করেনি তা বলা যাবে না। তবে পশ্চিমা অধিকাংশ দেশেই রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে বলে রাজনীতিকরা নিজেদের যোগ্য করার বিষয়ে সচেষ্ট হন। প্রতিযোগিতাও থাকে অমনই। আমাদের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। 

মাহিয়া মাহি রাজনীতিবিদ নন। অন্তত কয়েক বছর আগে তা-ই বলা যেত। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট আলাদা। সময় বদলেছে। অভিনয়ের তুলনায় রাজনীতিতেই যেন বেশি সময় দিয়েছেন। তবে সাধারণ মানুষের মাথায় তিনি এখনও ফিল্মের ভেতরে আবদ্ধ একজন। বাস্তবে তিনি রক্তমাংসের মানুষ হলেও তাকে সবাই যেন স্ক্রিনের কেউ ভাবেন। কেউ ভাবতে পারেন না তিনিও রাজনীতিতে আসতে পারেন। রাজনীতির অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে তাকে রাজনীতিক করতে পারে তা যেন কেউ যাচাই করার সুযোগ পায়নি। মাহিয়া মাহি যখন বলেন, “আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছি, মানুষের কষ্টের কথাগুলো শুনেছি। এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তাদের জন্য করার অনেক কিছু আছে। আমি যদি সুপ্রিম পাওয়ার পাই, তাহলে বৃহৎ পরিসরে তাদের সহযোগিতা করতে পারব। আর না পেলেও আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের সহযোগিতা করব।” 

তখন তার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি স্পষ্টই পাওয়া যায়। একজন অভিনেত্রী রাজনীতিতে আসতেই পারেন। এবারও অভিনয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় মনোনয়ন পেয়ে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। মাহিয়া মাহি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ার বিষয়টি ইতিবাচক বটে। তবে তা নারীর ক্ষমতায়নের ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পূর্ণ প্রমাণ নয়। মাহিয়া মাহির বিরুদ্ধে নানা ভিডিও ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে তা-ই কি প্রমাণিত হয় না? এসব মন্তব্যে রাজনীতিসচেতনতার ছিটেফোঁটা কতটুকু? সূক্ষ্মভাবে ভাবলে কম। অথচ মাহিয়া মাহির নির্বাচনে পরাজয়ের পর আবেগ সংযত রেখে বক্তব্য দেওয়ার এই পরিচয়ে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রমাণও বলে দেয়, তিনি তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ করছেন। সামনে তিনি আরও পরিণত হয়ে ফিরবেন। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই তিনি ভোটের অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলেন, “একটা বিষয় শেখার আছে। পাঁচ বছর জনগণের কাছাকাছি গেলে, তাদের কাছে গিয়ে ভোট চাইতে হবে না। আমি যেহেতু প্রচারণার সময়টা কম পেয়েছি, এর মধ্যেও যথেষ্ট মানুষের কাছে গিয়েছি। ভোটকেন্দ্রগুলোতে তুলনামূলক নারীদের উপস্থিতি বেশি। ভোট দিতে আসার জন্য নারীদের একটা উচ্ছ্বাস কাজ করছে।” 

তিনি এও বলেন, নির্বাচনে জয়ী হওয়া সহজ নয়। যুৎসই একটি প্রশ্নও ছুড়েছেন, “আপনারা, আপনাদের কাছের কেউ নির্বাচন করলে তখন বুঝতে পারবেন, এটা কতটা কঠিন।” অবশ্য কতজন তা খতিয়ে দেখবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে এটা সন্দেহ নেই, মাহি আরও পরিণত হয়ে ফিরবেন। তার আগ্রহ ও উৎসাহকে ট্রল করে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা অন্যায়। স্ক্রিনের মাহি আর রাজনীতির মাহিকে গুলিয়ে ট্রল আগেও কয়েকবার হয়েছেন মাহি। এবার অবশ্য আগেরবারের রেশ থেকেই যেন হয়েছেন বেশি। এটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে হচ্ছে। এমনটি অনেক ক্ষেত্রেই অনেককে রাজনীতিতে সদিচ্ছা রাখার ক্ষেত্রে অনুৎসাহিতও করে। তবে কি আমরাই সদিচ্ছাধারীদের পছন্দ করি না? নাকি রাজনৈতিক সংকট আমাদের এমনই ছত্রছায়া করে রেখেছে যে স্ক্রিন থেকে কাউকে বাইরে আসতে দিতে রাজি হচ্ছি না? প্রশ্নটা জটিল, উত্তর আরও।

লেখক : সংবাদকর্মী

Link copied!