বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে একটা মাইন্ডসেট আছে, জীবনে ব্যর্থরাই বুঝি শুধু আত্মহত্যা করেন! অথচ জগতের বহু সফল ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। কেন করেছেন, সে হিসেব কেউ মেলাতে পারে নি। তাছাড়া সফলতার সংজ্ঞাও বড্ড গোলমেলে। The old man and the sea এর মতো একটা উপন্যাস, যা পড়লে যে কেউ নতুন জীবনীশক্তি পায়, যেখানে লেখা রয়েছে, Man can be destroyed but not defeated—সেই উপন্যাসের স্রষ্টা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কেন নিজেকে হত্যা করলেন, এ জটিল অংকের হিসেব কি আর মেলানো সম্ভব?
সবার প্রিয় কমেডি অভিনেতা, রবিন উইলিয়ামস, লিংকিং পার্কের চেস্টার বেনিংটন, সুশান্ত রাজপুত, সালমান শাহ ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত সফলতার সময়েই নিজেদের শেষ করে দিয়েছেন। এ তো গেলো বিখ্যাতদের কথা। আমাদের সাধারণ জীবনেও যাদের আমরা সফল, সম্ভাবনাময় হিসেবে বিচার করি, দায়িত্বশীল পদ ও কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন, এমন ব্যক্তিরাও কাছের মানুষদের বিস্মিত করে দিয়ে বেছে নিচ্ছেন ভয়াবহ আত্মহত্যার পথ। যত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই হোক না কেন, কেউ যখন এমন পথ বেছে নেন, তিনি মূলত নিজের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সরে গিয়েই কাজটি করেন। একজন দায়িত্বশীল সুস্থ ব্যক্তি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
সম্প্রতি ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ বেছে নেওয়ার অধিকার নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। সঞ্জয়লীলা বানসালীর ‘গুজারিশ’ মুভিটি যারা দেখেছেন, তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর গুরুত্ব হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবেন। সেক্ষেত্রে একমাত্র শারীরিকভাবে অসুস্থ, কখনোই সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল—এমন ব্যক্তির স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সাদি মহম্মদ একজন সুস্থ সবল মানুষ, রাষ্ট্রকে তাঁর এখনো বহু কিছু দেওয়ার ছিল, শিক্ষার্থীদের এখনো অনেক কিছু শেখার ছিল তাঁর কাছে, তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার থাকতে পারে না। এমন কি গুজারিশ মুভিতে ঋত্বিকেরও স্বেচ্ছামৃত্যুর বিপক্ষে আমি। কেননা, বিখ্যাত জাদুকর হিসেবে তার জ্ঞান অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার সুযোগ ও অপশন তার ছিলো; নিজের ব্যক্তিগত জীবন যতই যন্ত্রণাময় হোক না কেন! ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে আরও উচ্চতর মানব হওয়ার চাপ হয়তো অনেকেই নিতে পারেন না। কিন্তু অন্যদের দিকে তাকিয়েও নিজেদের ইচ্ছাকে বিসর্জন দেওয়া যায়, সে তো নিজেদের মায়ের দিকে তাকিয়েও আমরা কিছুটা শিখতে পারি!
একদিকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষে বিপক্ষে শোরগোল, আরেকদিকে লাইফ সাপোর্টে থাকা প্রিয়জনের অক্সিজেনের নল খুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তহীনতার মুহূর্ত! ভাবুন তো একবার!
শারীরিকভাবে সুস্থ সবল মানুষও জীবনকে বইতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আবার পাশাপাশি দেখি সেই মানুষটিকে, যিনি জীবনের ৭০টি বছর কাটালেন লোহার ফুসফুসে নিজেকে বন্দী করে। সারাটা জীবন একটা লোহার বাক্সে বন্দী হয়ে কাটিয়ে দিলেন, তবুও মৃত্যুর কথা ভাবেননি! ৭২ বছর বয়সে আলেকজান্ডার অবশেষে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের কথা নয়, একই মাটির পৃথিবীতে পাশাপাশি ঘটে চলা ঘটনার কথা বলছি।
আমাদের চারপাশে মৃত্যুর অনুষঙ্গই বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, গুম, খুন, চিকিৎসকের অবহেলা কতই কারণ রয়েছে অপমৃত্যুর। তবুও জীবনের উৎসবে মানুষ মেতে থাকুক। একজন দায়িত্বশীল সুস্থ মানুষ বরং স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইবে।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































