পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ও কন্যাশিশুর অবস্থান কোনোদিনই ভালো ছিল না। বর্তমানে তা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যুগ যেমন পাল্টাচ্ছে, তেমনই নারী ও কন্যাশিশুরা সমাজে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। ঘরে-বাইরে-স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায়—কোথাও নারী-শিশু নিরাপদ নয়। ভয়াবহ এক অমানিশা নারী ও কন্যাশিশুর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৬৯৫ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যার শিকার হয়েছেন। যা নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য বড় সংকটের সংকেত বহন করছে।
গণমাধ্যম বরাতে জানা যায়, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়নের পাশাপাশি শিশুদের জন্য পৃথক অধিদপ্তর গঠনের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের নেতারা। তারা জানান, চলতি বছরের ১০ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) সারা দেশে ৬৯৫ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ৫০২ জন এবং কন্যাশিশু ১৯৩ জন। এ সময়ের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৫৯০ জন, যাদের মধ্যে ৩৪৭ জন নারী এবং ২৪৩ জন কন্যাশিশু।
এ ছাড়া পারিবারিক সহিংসতার শিকার ১৭৯ জন নারী ও ২০ কন্যাশিশু। পাচার ও অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩২ নারী ও ১৩৬ কন্যাশিশু। বিদ্যমান এ বাস্তবতায় নারী ও শিশুর সুরক্ষার জন্যই এটি জরুরি।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ২০২৩ উপলক্ষে এডুকো (এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) বাংলাদেশের সহযোগিতায় এক সংবাদ সম্মেলনে নারী নির্যাতনের এসব তথ্য তুলে ধরে সুরক্ষা আইন প্রণয়নের পাশাপাশি পৃথক অধিদপ্তর গঠনের দাবি জানায় জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এডুকো বাংলাদেশের সহায়তায় ৭০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং ২৮টি ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি।
উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০২২ জন। এদের মধ্যে ৩৬২ জন নারী ও ৬৬০ জন কন্যাশিশু। একইসঙ্গে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল আরও ৫৩ জন নারী ও ১৩৬ কন্যাশিশুকে। ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ১৩ জন নারী ও ৩৪ জন কন্যাশিশু। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন মোট ৩৫২ জন। যার মধ্যে ৯৬ জন নারী ও ২৫৬ জন কন্যাশিশু।
ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি মূল প্রবন্ধে বলেন, “স্বাধীনতার ৫২ বছরে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে কাঙ্ক্ষিত অর্জন নিশ্চিত হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হচ্ছে, আমাদের নারী ও কন্যাশিশুদের এখনো বঞ্চনা-বৈষম্য এবং নিপীড়নের থেকে মুক্তি ঘটেনি। বরং তাদের প্রতি সহিংসতা যেন ক্রমাগত বাড়ছে। পরিবারে, সামাজিক পরিসরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যানবাহনে—কোথাও এ দেশের নারী ও কন্যাশিশুরা নিরাপদ নয়। নারীর ও কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতার একটি বড় অংশ হচ্ছে যৌন হয়রানি।”
নাছিমা আক্তার জলি বলেন, “২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম মনে করে, সংসদ নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের কাছে নারী ও কন্যাশিশুদের সমস্যার ব্যাপকতা তুলে ধরা প্রয়োজন। যাতে দলগুলো তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহারে নারী ও কন্যাশিশুদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ তুলে ধরে এবং বিজয়ী দল সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে।”
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের দেওয়া তথ্য মতে শুধু ৬৯৫ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যারই শিকার হননি বরং ১০২২ জন নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকারও হয়েছেন! সংখ্যাটা মাত্রাধিক! এত নারী ও কন্যাশিশু সমাজে হত্যা ও ধর্ষণের শিকার তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় সমাজে নারী ও কন্যাদের নিরাপত্তা কোথায়? এতটা ভয়ঙ্কর উঠছে কেন এ সমাজ? এখন নারী-পুরুষ উভয়ই সমানভাবে বাইরের পৃথিবীতে বিচরণ করছে। সবাই নাহলেও অধিকাংশ নারী নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কেউবা ব্যবসা করছে, ছোটখাটো চাকরি করছে আবার কেউ তার অবস্থান অনুযায়ী পেশা বেছে নিচ্ছে তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে নারী-কন্যাশিশুরা আজ ভালো নেই। তাদের জীবনে যে ঘনঘটা, যে শঙ্কা তার দায় কার? এ সমাজ নারীকে অবরুদ্ধ রাখতে পছন্দ করে, সে ক্ষোভ বা রাগই কি এত এত নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা-ধর্ষণের শিকার করে তুলছে! কোন সমাজে বসবাস করছি আমরা? যেখানে একটি সেকেন্ড একজন নারী নিরাপদ নয়!
সেমিনারে অংশ নেওয়া সমাজসেবক ও সুশীলসমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতেই হয় সামনে নির্বাচনকে ঘিরে নারীদের জন্য নতুন ইশতেহার গঠন করতে হবে। তার প্রথম ও বাস্তবায়নযোগ্য শর্ত হতে হবে, নারীর নিরাপত্তা। নারী ও কন্যাশিশুরা এভাবে অকালে হারিয়ে গেলে এ সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হবে। সমাজ নষ্ট হবে। অবিশ্বাস, অপরাধ ক্রমাগত বাড়বে। আজ ১০০ জনে ১ জন হত্যা বা ধর্ষণের শিকার হলে আগামীকাল তা আরও বাড়বে! এখনই সময় এর লাগাম টেনে ধরা। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর থেকে কঠোরতার শাস্তি প্রদান করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নৈতিকতার শিক্ষা, মানবিক বোধের উদয়, সহানুভূতি-সহমর্মিতা পারে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে পরিত্রাণ দিত।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































