চলতি বছরের ১৫ আগস্ট একটি গার্ডার পড়ে ৫ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এই গার্ডার দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বেশ ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায়, গার্ডারটি পড়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কোনোমতে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, আর সেকেন্ডের মধ্যেই গার্ডারটি পড়ে যায় প্রাইভেট কারটির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সড়কের অন্যান্য যান চলাচলও থেমে যায়। সেই অটোরিকশায় কিংবা প্রাইভেট কারের পেছনের বাসে যারা ছিলেন, নিশ্চয়ই ‘একটুর জন্য’ বেঁচে যাওয়াতে স্বস্তি বোধ করেছেন। জীবনের আশা ফিরে পেয়েছেন।
চলুন আরেকটি ঘটনা ভেবে দেখা যাক। হয়তো আপনি কোনো বাস বা ট্রেনের টিকেট কেটেছেন। কিন্তু ‘একটুর জন্য’ সেই বাস/ট্রেন মিস করে গেছেন, যেতে পারেননি। এ জন্য আপনার আফসোসের শেষ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই জানতে পারলেন, সেই বাস/ট্রেন দুর্ঘটনায় সকল যাত্রী নিহত হয়েছেন। দুঃখজনক এমন ঘটনাতেও আপনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, ‘আমি তো বেঁচে গিয়েছি’—এই আনন্দে। ভাগ্যক্রমে সেই বাস/ট্রেন মিস করে যাওয়াতে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতাও জানালেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, ওই বাস বা ট্রেনে আরও যাত্রী ছিলেন, তারাও এই একই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, প্রিয়জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
একবারও কি ভেবে দেখেছেন, আপনার এই বেঁচে যাওয়া ‘সাময়িক’ বেঁচে যাওয়া। যতদিন নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত না হবে, ততদিন এমন ঘটনা ঘটেই যাবে। হয়তো আজ আপনি বেঁচে গেলেন। কিন্তু দুদিন পরেই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, হয়তো আপনার সাথে কিংবা আপনার কোনো প্রিয়জনের সাথে। তখন কী বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেবেন?
কোনো নারী নির্যাতিত হলে, ধর্ষণ বা ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে আপনি প্রতিবাদ করেন না। উলটো ভিক্টিম ব্লেম করেন। কারণ তথাকথিত ‘সেইফ জোন’-এ আপনি রয়েছেন বলে মনে করছেন। কখনো এরকম বিপদের মুখে পড়তে হবে না, এমন ভ্রান্ত ধারণায় আপনি আশাবাদী। অন্য কোনো কর্মস্থলে কোনো নারী যৌন হেনস্থার শিকার হলেও আপনি মাথা ঘামান না, কারণ, আপনার কর্মস্থলে নারী বান্ধব ও নিরাপদ পরিবেশ রয়েছে। কিংবা ধরা যাক, আপনার নিজের কর্মস্থলেই অন্য নারী সহকর্মী যৌন হেনস্তার শিকার হলো। তবুও আপনি না দেখার ভান করে থাকেন। কারণ, ‘আপনার বেলায় তো এমন কিছু ঘটেনি।’ কিন্তু আপনি ভুলে যান যে, নিজেরটুকু নিয়ে সীমাবদ্ধ জীবন কাটাতে পারাই সব নয়। হয়তো অন্য কোনো কর্মস্থলে আপনারই কোনো প্রিয়জনের যৌন হেনস্তার ঝুঁকি রয়েছে। আজ আপনার বেলায় কোনো বাজে ঘটনা না ঘটলেও, ভবিষ্যতে আপনার ও আপনার প্রিয়জনের মধ্যে এর থেকেও ভয়ঙ্কর বাজে ঘটনা ঘটবার ঝুঁকি কি রয়ে যায় না? তাহলে ঘরে, বাইরে, কর্মস্থলে, যেকোনো স্থানে, যে কোনো নারী বা শিশুর যৌন হেনস্থার ঘটনায় আপনি সচেতন না হয়ে উলটো ভিকটিম ব্লেমিং করেন কিসের আশায়?
কেন ভুলে যান, যে সিস্টেম আজ আপনি নিজে সৃষ্টি করছেন, ওই সিস্টেমের বেড়াজালে আপনি নিজেও একদিন আটকা পড়ে যাবেন। সেদিন আপনার পাশেও কাউকে পাবেন না। কেন ভুলে যাচ্ছেন, শুধু আপনার জীবনই নয়, সবার জীবনই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধু আপনি একা বেঁচে গেলে বা রক্ষা পেলে গেলেই হবে না। স্বার্থপরতার নাগরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি অপরাধ , হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকেই সচেতন হতে হবে। তা না হলে শুধু দুর্নীতিবাজ অপরাধী, খুনি আর ধর্ষকরাই সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের অপকর্মগুলো আরও নির্বিঘ্নে চালাতে পারবে। সে সব ভয়ঙ্কর দিন আমাদের যেন আর দেখতে না হয়, তাই সবাইকেই নাগরিক দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। শুধু ‘আমি বেঁচে গিয়েছি’তে স্বস্তি পাওয়া নয়, বরং সবাইকে নিয়ে নাগরিক অধিকারসহ সুস্থ ও নিরাপদে থাকার মানসিকতা তৈরি হোক।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক।