• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্মূলেই একুশে আগস্ট হত্যাকাণ্ড


নুরুজ্জামান মানিক
প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৩, ০৯:০৪ এএম
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্মূলেই একুশে আগস্ট হত্যাকাণ্ড

আজ রক্তাক্ত বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার আজ ১৯তম বার্ষিকী।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে এই নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হিংসার দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার জঘন্য অপচেষ্টার দিন। এর শুরুটা হয়েছিল পঁচাত্তরে। প্রসঙ্গত, বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাখি ডাকা ভোরে। বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে সেদিন পৈশাচিক উন্মত্ততায় হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই আত্মজা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। সক্রিয়ভাবে কারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তা আজ আর অজানা নয়। তবে নেপথ্যের দেশি-বিদেশি কুশীলবদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। এখানে খুনি ফারুকের স্বীকারোক্তিকে আমলে নিয়ে যে কথা বলতে চাই, তা হলো মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্মূল করাই ছিল পনেরো আগস্ট ক্যুর মূল লক্ষ্য। খুনিদের আসল অবস্থান ছিল, যে চার মূলনীতি আমাদের আদি সংবিধানে গৃহীত হয়েছিল তাদের বিপক্ষে। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ধারাবাহিকভাবে সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। বঙ্গবন্ধুকে রেখে এই পরিবর্তনগুলো আনা যেত না। আনবার উপায় ছিল না। তাই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে সপরিবার। ভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা । কিন্তু তাদের ওপর হত্যা প্রচেষ্টা আজও চলমান।

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর ক্ষমতা নয়, দেশের মানুষের অধিকার, যুদ্ধাপরাধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেন। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি এসব বিচারের রায় কার্যকর করেন। এসব কঠিন কাজ সম্পন্ন করতে তিনি শত্রুপক্ষের কমপক্ষে ১৯ বার হত্যাচেষ্টার সম্মুখীন হন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তাকে হত্যার চেষ্টা হয়। ওই দিন তার গাড়িবহরে গুলি করা হলে ২৪ নেতাকর্মী শহীদ হন। একই বছরের ১৫ আগস্ট ও ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির কর্মীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির গ্রিন রোডের পরিবার-পরিকল্পনা ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে হত্যার চেষ্টা হয়। ট্রেনে গুলিবর্ষণ করে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কোয়ারে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার সময় নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন। ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে অস্ত্রধারীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়, তবে বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় তিনি রক্ষা পান। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। ঘাতক চক্র সেখানে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখেছিল। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িতে হামলা চালানো হয়। একই বছর ২৯ সেপ্টেম্বরে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়। একই বছর ৩০ আগস্ট শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তার গাড়ি বহরে হামলা চালানো হয়। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে ঘাতকের বুলেট থেকে শেখ হাসিনা রক্ষা পান। একই বছর ২১ আগস্ট ছিল নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। 

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে অকল্পনীয় এক নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের জন্ম দেয়। ওই দিন সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে করা হয় একের পর এক গ্রেনেড হামলা। নেতাকর্মীদের মানববর্মে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সে সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের সেই সমাবেশে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকেল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়। ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর বসিয়ে দেন। এর পরপরই আরও তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়; চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নামিয়ে আনতে বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে। মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার সবাই ট্রাকের ওপর বসে পড়তে বাধ্য হন। নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, যেকোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে। শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন। ওই হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতাকর্মীরা। ওই অবস্থায় রিকশা, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। 

নিহত অন্যরা হলেন ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হন তারেক আহমেদ সিদ্দিক, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শোয়েব মো. তারিকুল্লাহসহ নেতাকর্মীদের অনেকে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের চিহ্ন আর পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। হামলার শিকার আওয়ামী লীগকেই দায়ী প্রমাণ করার নানা অপচেষ্টা চলে। বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে গঠন করা হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। ১ মাস ১০ দিনের মাথায় ১৬২ পৃষ্ঠার একটি ফরমায়েশি রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয় এই কমিশন। এরপর আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে শুরু হয় নানা নাটক। তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নিতে শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে আটক করে ফাঁসানোর চেষ্টা চলে। মঞ্চস্থ হয় জজ মিয়া নাটক। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগে জজ মিয়াকে আটক করার পর জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। এটি সাজানো নাটক প্রমাণ হওয়ার পর থামিয়ে দেওয়া হয় তদন্তকাজ। 

চার বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হত্যার অভিযোগ ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে বিচারও শুরু হয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। অধিকতর তদন্ত আসামির তালিকায় নাম আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনের। তারেকসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। বিচারকাজ চলার সময়ই অন্য মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল, মানবতাবিরোধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক এমপি কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। আর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। মামলার আসামি সাবেক পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। 

একুশে আগস্টের বিভীষিকাময় বিকেলের গ্রেনেড হামলার বিষয়টিও নিছক একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ছিল না। এটা ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে যেমন বাংলাদেশের রাজনীতির পশ্চাৎযাত্রা শুরু হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায়ই একুশে আগস্ট ঘটানো হয়েছিল আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্য, ক্ষমতার রাজনীতিতে দলটিকে অকার্যকর করার জন্য। কিন্তু এ কাজে যে জঙ্গিগোষ্ঠীকে ‘ভাড়া’ করা হয়েছিল, তারা সম্ভবত তাড়াহুড়া করতে গিয়ে টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের জীবন রক্ষা পেলেও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ কমপক্ষে ২৩ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। তাঁদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। কেউ কেউ এখনো শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধের পেছনে অন্যতম দুটি কারণের একটি পনেরো আগস্ট, অন্যটি একুশে আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার সময় বিএনপি ছিল না। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান। সরাসরি হত্যা মিশনে জড়িতরা জিয়ার সমর্থন, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় জিয়া কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্ক করা অর্থহীন। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের দেওয়া তথ্য থেকেই জানা যায়, হামলাকারীদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের যোগাযোগ ছিল। সে সময়ে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ‘হাওয়া ভবনে’ তারেক রহমান এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের উপস্থিতিতে হামলায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলেও তথ্য পাওয়া। সুতরাং যারা পঁচাত্তরের ঘাতক বা একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে এক করে দেখে তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা, গেট ওয়েল সুন।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Link copied!