স্থান, কাল, সংস্কৃতিভেদে ভূত অনেক রকম। যেমন শাঁকচুন্নি, মামদো ভূত, গেছো ভূত—এগুলো একেবারেই বাঙালি ভূত। আলিফ লায়লাতে পাওয়া যায় জিনের দেখা। পাশ্চাত্যে রয়েছে ড্রাকুলা, ওয়ারউলফ, কালো পোশাকের ডাইনি। আবার জাপানি ভূতের নাম জুজু। এ ছাড়া বীভৎস ভূতের মধ্যে আছে পিশাচ, রাক্ষস, দানব, স্কন্ধকাটা, জম্বি ইত্যাদি। নানান দেশের মিথেও রাক্ষস, দানব টানবের কথা রয়েছে প্রচুর। এখন বিজ্ঞানের যুগে এলিয়েন নামক আরেক চরিত্রের উদ্ভব ঘটেছে।
এবার আসা যাক, অতৃপ্ত আত্মাবিষয়ক ভৌতিক কাণ্ড কারখানার কথায়। পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, সেই আফ্রিকার আদিবাসী থেকে শুরু করে মিসরের ফারাও বা অন্য যে কোনো স্থানে, সর্বত্র এই অশরীরী আত্মার ধারণা মোটামুটি একই রকম। মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মা নানা রকম ভৌতিক কাণ্ড ঘটায় আর তা নিয়ে অসংখ্য গল্প রয়েছে।
পৃথিবীতে যত রকম ভূত আছে, প্রায় সবই ভয়ের। তবে মজার ভূতও আছে কিছু। যেমন ক্যাস্পার। কিংবা হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র ‘টুত’। আরও আছে পরীর গল্প। বেশির ভাগ পরী ভালো হয় বলে ওদের অবশ্য কেউ ভূত বলে অসম্মান করতে চায় না। তবে এ কথাও শোনা যায়, মেয়ে জিনরাই নাকি পরী!
আসলে গল্পকারের ওপরই নির্ভর করে ভূতের চরিত্র ভয়ংকর হবে নাকি মজার। শাঁকচুন্নি, জিন, মামদো ভূত, ড্রাকুলা, পরী, এলিয়েন ... প্রতিটি ভূতের গল্পের আলাদা একটা আমেজ থাকে।
সারা বিশ্বেই হরর মুভি খুব জনপ্রিয়। এই মুভিগুলোর দর্শকরা যে ভূত-প্রেতে খুব বিশ্বাস করেন, তা নয়। ভূতের ভয়ের একটা আলাদা থ্রিল পাবার জন্যই এসব তারা মুভি দেখে থাকেন। সম্প্রতি নুহাশ হুমায়ূনের ওয়েব সিরিজ ‘পেট কাটা ষ” ও চলচ্চিত্র ‘মশারি’ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধরনের সিনেমা বা নাটক এর আগে বাংলাদেশে তেমন হয়নি। যদিও সাহিত্যে রহস্যময় ভৌতিক গল্প সব সময়ই ছিলো। পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই, এ কথা জেনেও গা ছমছমে অনুভূতি পাবার জন্যেই এসব পড়ে থাকেন পাঠকেরা। শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও ভূতের গল্প পড়তে ভালোবাসেন। এ ছাড়া বড়রা ভূতের ভয় দেখিয়ে শিশুদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে থাকেন। ছোট্টবেলায় একবার ভূতের ভয় মনের মধ্যে ঢুকে গেলে শত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতেও সে ভয় দূর হয় না।
জিন ভূতের গল্প পড়ে বা মুভি দেখে বিনোদন পাওয়া এক ব্যাপারে আর এগুলোতে অন্ধভাবে বিশ্বাস রাখা আরেক ব্যাপার। অনেকেই ধর্মীয় কারণে অন্ধভাবে জিন-ভূতে বিশ্বাস রাখেন। ধর্মগ্রন্থে এসবের উল্লেখ থাকাতেই এ রকম বিশ্বাস আরও পাকাপোক্তভাবে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। ফলে হাজারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতেও কোনো কাজ হয় না। মনগড়া জিন ভূতের গল্পই উল্টো বিশ্বাস জাগায়। এ কারণেই রেডিওতে ভূত এফ এম অনুষ্ঠানের এত জনপ্রিয়তা। এমন কি ট্রাভেলাররাও ইদানীং পাহাড়ে ভ্রমণ করতে গিয়ে জিন-ভূতের কেচ্ছা কাহিনীর জন্ম দিচ্ছেন। আদতে এসব জিন-ভূতের বিশ্বাসে মানুষের কি কোনো কল্যাণ আসছে?
মানুষের মনে কোনো কিছুর ওপর বিশ্বাস থাকাটা জরুরি, যখন তা মানব কল্যাণের কাজে আসে। জিন-ভূতের বিশ্বাস মানুষের কোনো কল্যাণ এনে দেয় না। বরং মানুষ জিনের ভয়ে ভীত থাকে, কোনো স্থানে একা অবস্থান করতে পারে না। এ ভয় মানসিকভাবেও ব্যক্তিকে দুর্বল করে দেয়। মানুষের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে কথিত পীর হুজুরেরা দেদারসে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তাদের কথা বিশ্বাস করে কত অসুস্থ মানুষ যে হাসপাতালে চিকিৎসা না নিয়ে পীরদের পানি পড়া, তাবিজ নিয়ে আরও অসুস্থ হয়েছে। কত মানসিক রোগের রোগীকে জিন আছর করেছে বলে ঝাঁটা, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অত্যাচার করেছে। কখনো কখনো নারী রোগীদের সুস্থ করে দেওয়ার নাম করে বন্ধ ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে। আর সাধারণ মানুষ জিনের বিশ্বাস থেকে এই সব অপকর্ম মেনে নিয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তাদের প্রিয়জন আরও অসুস্থ হয়ে গেছে কিংবা মারা গিয়েছে। আর ওদিকে পীরেরা লোক ঠকিয়ে জিনের নামে ব্যবসা করেই যাচ্ছে। এতে মানুষের কী কল্যাণ হলো?
হয়তো বলবেন, জিনের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, কিন্তু কী সেই সমস্যা, কেউ বলতে পারে না। নিজের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হয়। জিন দিয়ে সমস্যা সমাধান করা আর ডোরিমন কার্টুনের সেই সব কাল্পনিক গ্যাজেট দিয়ে সমাধান করার চিন্তা একই রকম অবাস্তব ও শিশুতোষ। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক দম্পতি দাবি করেছে, তাদের কাছে নাকি পোষা জিন আছে। যখনই কেউ তাদের ভণ্ডামি ধরে ফেলে, তারা তখন ক্ষতি করার হুমকি দেয়। তার মানে দেখা যাচ্ছে, জিন দিয়ে শুধু ক্ষতিই করা যায়, ভালো কিছু নয়।
জিন ভূতের ভয় বা বিশ্বাস তৈরি করে অপরাধীরা তাদের অপকর্ম সাধারণ মানুষের চোখের আড়াল করে রাখে। যেখানে ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধ ঘটিয়ে জিনের কর্ম বলে লোকের চোখে ধুলো দিচ্ছে অপরাধীরা, সেখানে এমন বিশ্বাসে কী এমন উপকার হচ্ছে সাধারণ মানুষের?
এতই যদি জিন ভূতের বিশ্বাসের দৌরাত্ম্য থেকে দেশে, তবে রাতের বেলার ভৌতিক ভোটে ব্যালট বক্স ভরে যাওয়া, সাগর রুনির রহস্যময় হত্যাকাণ্ড, তনু ধর্ষণ ও খুন, হঠাৎ গুম হয়ে যাওয়া, বুয়েটে শিক্ষার্থী ফারদিনের মৃত্যু রহস্যের একমাত্র কারণ এইসব জিন! এমনকি বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের দাবি জানিয়ে সম্প্রতি ঢাবির রাজু চত্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিলো, সেটিও হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। নির্ঘাত জিনেরই কাণ্ড হবে। সুতরাং দেশে আইনশৃঙ্খলা ও বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আর অনাস্থা কেন? সব কিছুর জিনের বিশ্বাসের ওপর চাপিয়ে দিলেই হলো।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক








































