করোনায় ঈদ উদযাপন, টিকাই ভরসা


তুষার আবদুল্লাহ
প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২১, ০৬:২৩ পিএম
করোনায় ঈদ উদযাপন, টিকাই ভরসা

১০ নম্বর বিপদ সংকেতের পূর্বাভাস জেনে, আমরা যেমন বসে থাকি বিধ্বস্ত হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে, এখন ঠিক তেমন আছি। ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই তার প্রভাব বা তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। যা দেখে আমরা ক্ষতি আঁচ করতে পারি। কোভিড-১৯-এর বেলায়ও তাই হচ্ছে। ২০২০ থেকেই আমরা কোভিডের একাধিক ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। মৃত্যুর হিসাব করতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। করোনাকালে চার ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতা আমাদের। প্রতি ঈদেই আমরা শঙ্কায় থেকেছি, ঈদের পর অদৃশ্য জীবাণুর হানা কেমন প্রলয়ংকরী হয়। যতবার করোনা প্রতিরোধে বা সংক্রমণ কমানোর জন্য আমরা এগিয়ে গেছি, ততবারই ঈদ আমাদের পেছনে নিয়ে গেছে। এবার যখন ঈদ এলো, তখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে লন্ডভন্ড বাংলাদেশ। শহর-গ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। প্রতিদিন আগের রের্কড ভাঙছে মৃত্যু। এই মূহুর্তের পূর্বাভাস ঈদের পর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ।

ঈদে এবার সাধারণের জন্য বড় উপহার ছিল লকডাউনের ৯ দিনের ছাড়। কঠোরের মাঝে ঈদ ধামাকা। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর থেকে মানুষ ছুটল গ্রামে। ভয়  ওই গ্রাম নিয়েই। এখন গ্রাম ও জেলা শহরে করোনার সংক্রমণ বেশি। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝে একবার ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ছিল। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এখন আবার বলা হচ্ছে ২৩ জুলাই থেকে আবার ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করা হবে, ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউন কঠোর থেকে কঠোরতার হবে। বন্ধ থাকবে গার্মেন্টস কারখানা। কিন্তু প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে এসে লকডাউনের যে স্বাদ পাওয়া গেছে, তাতে কঠোরতা নিয়ে আশ্বস্ত বা বুক কেঁপে ওঠার কোনো কারণ নেই।

ঢাকা ছেড়ে যাওয়া নিয়ে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ট্রল বা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করি। অবশ্য এই বিদ্রুপকে তোয়াক্কা করেন না গ্রামমুখী মানুষ। আমাদের বিদ্রুপ প্রিয়জনের জন্য, গ্রামে থাকা পরিবারের জন্য গতর খেটে যারা টাকা নিয়ে বাস, ট্রেন , লঞ্চে বা ট্রাকে ঝুঁকি নিয়ে ছুটছেন তাদের নিয়ে। এই মানুষগুলো লকডাউন কাজ হারায়। কাজ হারালে তাদের খাবার ও বাসস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তখন শহরে থাকার চেয়ে গ্রামে থাকাটা তারা নিরাপদবোধ করেন। সেখানে অল্প রোজগার, কিংবা পরিবারের সঙ্গে মিলে গিয়ে কোনোভাবে জীবনটাকে যাপন করা যায়।

আমরা এমন অনেক মধ্যবিত্তের কথা জানি, যারা রাতের আঁধারে বা চুপিচুপি শহর ছেড়েছেন। ঢাকা থেকে গ্রামে জিনিসপত্র বহন করে নিয়ে যাওয়ার খরচও ছিল না তাদের। জলের দরে বেচে দিয়েছেন আসবাব। রাজধানী ছেড়ে জেলা শহরে গিয়ে ভাড়া বাড়িতেই উঠেছেন কোনোরকমভাবে। লকডাউনের দুই বছরে হাতে গোনা কিছু মানুষ কোটিপতি হয়েছেন। সরকারি চাকরিজীবীরা নিরাপদে আছেন। বাকিরা কিন্তু আছেন ঝুঁকিতে। যেকোনো সময় কাজ হারানোর ঝুঁকি। এই মানুষগুলোই শহর আর গ্রামের টানাপোড়নে আছেন। যারা উড়োজাহাজে, ব্যক্তিগত গাড়িতে শহর ছাড়েন, তারা ট্রল হন না, এখনো তাদের নিশ্চিত আছে যাপনের নিরাপত্তা।

৫০ বছরে আমরা যা পারিনি , তা হচ্ছে স্থানীয় সরকার কাঠামোকে তথ্য-উপাত্ত নির্ভর করতে। এবং তাদের অধিকাংশই আয়ের দিক দিয়ে শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে জানে না কোন পেশায় কতজন কাজ করে। গ্রাম বা ইউনিয়নে আয় বা পেশার ভিত্তিতে জনগণের তথ্যও সংরক্ষিত নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেও তা নিশ্চিত করা যায়নি। দেশে ভাসমান মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এদের গতিবিধি অনুসরণ করে তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে লকডাউনে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাঠামোগত সামর্থ্য রাষ্ট্রের নেই। এই বিষয়টি অবশ্য রাষ্ট্র অনুধাবন করতে পেরেছে শতভাগ। তাই জীবনের ঝুঁকি চরম পর্যায়ে চলে এলেও তাকে বাধ্যগতভাবে জীবিকার ছাড় দিতে হয়। সরকার নানা খাতে নগদ অর্থ বাজারে ছাড়ছে প্রণোদনা ও অনুদানের আকারে। কিন্তু সেই টাকার খুব কম অংশই বাজারে আসছে।

সুবিধাভোগীদের মাধ্যমে টাকা বাজারে যাওয়ায়, তাদের পকেটেই রয়ে যাচ্ছে অনেক টাকা। ফলে সাধারণ মানুষ কাঙ্ক্ষিত উপকারভোগী হতে পারছে না । উৎপাদনও বন্ধ ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বারবার। ফলে শ্রমিক মজুরি বঞ্চিত। এমন অর্থনৈতিক অবস্থাতেও কোরবানির হাট এবার জমজমাট। গত বছরের চেয়ে বেশি কোরবানি হচ্ছে। তবে কোরবানির সংখ্যা দিয়ে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বিবেচনা করা যাবে না। ধর্মীয় আনুগত্যপ্রবণ দেশে পুঁজি ভেঙে, সুদে ঋণ নিয়েও মানুষ কোরবানি দিচ্ছে।

আমরা যে নতুন স্বাভাবিক জীবনের কথা বলছি, সেই জীবন কবে যে শুরু হবে, তা অনিশ্চিত। শিক্ষা তো স্থবির হয়েই আছে। আপাতত মানসিক প্রশান্তি হিসেবেও ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক নেওয়াটাই মোক্ষম উপায় মনে হচ্ছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে যত দ্রুত টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে, ততই হয়তো প্রাণে সাহস পাব, নতুন স্বাভাবিক জীবনের উৎসবে ফেরার।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

Link copied!