• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
স্মরণ

কবি আসাদ চৌধুরীকে চির প্রণাম


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৩, ০৪:২৭ পিএম
কবি আসাদ চৌধুরীকে চির প্রণাম

প্রথম দেখি কবে তাকে! বহু বছর আগের কথা। সম্ভবত নব্বই দশকের শুরু হবে। পরনে আমার হাফপ্যান্ট। মধ্যাহ্নে স্কুল থেকে ফিরছিলাম সেদিন। বাসায় এসে দেখি সফেদ সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক, চোখে চশমা। পায়জামা পাঞ্জাবি তার প্রিয় পরিধান ছিল। মুখের কোণে লেগে আছে পানের লাল ছিটা। রসিয়ে রসিয়ে পান খাওয়া তার বিশেষ পছন্দ। স্মিত হেসে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছো?

তিনি আসাদ চৌধুরী—কবি আসাদ চৌধুরী; মিতভাষী, সজ্জন, হৃদয়বান, ছান্দসিক তার মতো কেউ নেই দুই বাংলায়।

নোয়াখালীতে জাতীয় কবিতা উৎসব উপলক্ষে তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তখন থেকে তাকে সরাসরি তাকে চিনি। এর আগে তাকে কবিতায় চিনতাম। টেলিভিশনে উপস্থাপনা করতেন, সেই সূত্রে তাকে চিনি। তার কণ্ঠস্বর ঐন্দ্রজালিক। তিনি দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী। বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চার ইতিহাসে তিনি অগ্রগণ্য পুরুষ।

বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, চ্যানেল আই কিংবা বাংলা একাডেমি বা শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ যে কোনো অনুষ্ঠানের তিনি সফল উপস্থাপক। শিল্প সাহিত্যের উপস্থাপক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান।

আমাদের অতি প্রিয় কবি ‍তিনি—আমাদের অভিভাবক। আমাদের সাহিত্যের প্রদর্শক। অপরিসীম ভালোবাসার এক মানুষ। তরুণ-নবীন থেকে শুরু করে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত আসাদ চৌধুরীকে গাঢ়ভাবে ভালোবাসেন। কবি আসাদ চৌধুরী মধুর ও আনন্দময় এক ব্যক্তি। ‘মাই ডিয়ার’ তার জন্য প্রযুক্ত।

আমার লেখালেখির সমান বয়স থেকে কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক। দীর্ঘ এক ভ্রমণ। পুরো দেশ তার সঙ্গে আছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নবীন-প্রবীণ লেখককূলের সঙ্গে তার বন্ধুতা। তার বিশাল ও উদার হৃদয়ের ডেরায় সবার প্রবেশাধিকার সমান।

দুই।  

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের সমাজ-রাজনৈতিক যুগপৎ দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাভূমি নিয়ে আলোচনা অনেক। আসাদ চৌধুরী এমনি এক সময়ের সন্তান, যার প্রেমও গ্রহণলাগা, ব্যক্তিবিরহও সামষ্টিক ব্যর্থতার রঙে রঞ্জিত। এর মাঝে স্মৃতি হয়তো বিশেষ করে আলোচ্য কোনো বিষয় হতে পারে না, তবু সরল রূপে যদি তাকে ইতিউতি পাঠের স্মৃতি থেকেই তার স্মৃতিসূত্র শনাক্তের প্রয়াস পাই, তবে হয়তো সামগ্রিকভাবে আমাদের কবিতার এক গতিমুখেরও সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

আসাদ চৌধুরীর কবিতায় আছে নতুন সুর। হৃদয়শালী আন্তরিক গীতিধর্মী তার কবিতা। লিরিকের সঙ্গে আধুনিকতার মিশ্রণ। ছন্দ উপলব্ধির সঙ্গে ছন্দহীনতার দ্রবণ তিনি কবিতার শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার কবিতায় আমরা মুগ্ধ পাঠক। দেশ, দেশের ঐতিহ্য, লোকায়ত জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, সহজিয়া ভাব এসবই তার কবিতার উজ্জ্বলতা। আধুনিকতার নামে অকারণ দুর্বোধ্যতা তিনি এড়িয়ে চলেন।

তিন।

আসাদ চৌধুরীর প্রথম কবিতা বই ‘তবক দেওয়া পান’—তার স্মৃতিচর্যারই প্রকাশ। সময়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত যে লোকাচার-লোকাভ্যাস লুপ্তপ্রায়, তাকে স্মৃতিতে জাগিয়ে রাখেন তার তবক দেওয়া পানের রূপকে। একদিন হয়তো পানের বরজ সব উঠে যাবে এ দেশ থেকে, একদিন এই তুমুল ফরমালিন-বাস্তবে প্রাণের ‘পান’ হয়তো নেবে বিষের আকার, তখন আসাদ চৌধুরীর কবিতাসূত্রে পান থাকবে আমাদের স্মৃতির গহনে। আর তার কবিতা মনে করিয়ে দেবে অলস দুপুরের বাংলা, একটু আয়েশি ভঙ্গি আর গুরুভার মজলিশে হালকা রসের ফোয়ারা।

চার।

মিলান কুন্ডেরা বলেন, উপন্যাস বা শিল্প হলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম; আসাদ চৌধুরী ঠিক তেমনি কবিতার মধ্যে দিয়ে জারি রাখেন সে সংগ্রাম। ঘোষণা দিয়ে আসাদ চৌধুরী রাজনৈতিক কবিতা লেখেননি কখনো, কিন্তু যখন ফেব্রুয়ারির অমর একুশের গ্রন্থমেলায় তার কবিতার পঙ্‌ক্তি প্ল্যাকার্ডে প্ল্যাকার্ডে জ্বলজ্বল করে জানায় যে কোনো নিপুণ জল্লাদের ক্ষমতা নেই যে ভাষাশহীদের গা থেকে একটিও লোম তুলে নেওয়ার দুঃসাহস দেখায়, তখন বুঝতে হয় কবিতার প্রয়োজন নেই স্লোগানে, বরং প্রকৃত কবিতাকেই সময় তার প্রয়োজনে স্লোগান করে নেয়; একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের সমর্থনে এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে আসাদ চৌধুরীর এই অনশ্বর কবিতা:

‘তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?’
(শহীদদের প্রতি)

আবার মুক্তিযুদ্ধের অনন্যসাধারণ কবিতা ‘বারবারা বিডলারকে’ তো আজ স্মৃতিসত্তার অনুপম যুগলবন্দীরূপে প্রতিভাত কবি, আবৃত্তিশিল্পী ও কবিতাপ্রেমী মানুষের কাছে—

‘টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা?
গির্জায় ধর্ষিতা সোফিয়া লরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা, শুধু খাঁ খাঁ করেছিল—
সোফিয়া লরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশ,
ত্রিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।

অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিঅলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না
স্বাধীনতার...’

পাঁচ।

অতি বিনয় ও আচার ব্যবহারের কোমলতা কবি আসাদ চৌধুরীকে করেছে জনপ্রিয়। তার অভিধানে ‘না’ নেই। শারীরীক অসুস্থতা থাকলেও তিনি ঢাকা বা ঢাকার বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে কথা দিয়ে থাকলে সেখানে অংশগ্রহণ করবেনই। কয়েক বছর আগের কথা, সম্ভবত ২০১০ সালের কথা। আমার এক বন্ধুর কবিতা বই বের হয়েছে। তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য আসাদ ভাইকে বলি। তখন তিনি অসুস্থ, তিনি বলেছেন আসবেন। এসেছেনও। কাউকে তিনি কখনো উপেক্ষা করেন না। উপেক্ষিত লেখকদের তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন। যে কোনো লেখককে তিনি সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। মানুষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা।

বাংলাদেশের ভূগোল তিনি খুব ভালোভাবে জানেন। পুরো দেশটা তিনি অনেকবার চষে বেড়িয়েছেন। জেলা-উপজেলা এমন কী সুদূর গ্রাম, বাংলা নদী তার সবখানে কবি আসাদ চৌধুরীর পদাস্পর্শ পড়েছে।

ছয়।

কবি আসাদ চৌধুরীকে চির প্রণাম। আসাদ ভাইয়ের মধুর ব্যক্তিত্বের সুগন্ধি উপলব্ধি করার জন্য বারবার তার সঙ্গসুধা পান করেছি। আসাদ ভাইয়ের সীমাহীন গুণপনা। তাকে নিয়ে কোনো লেখারই সমাপ্তি নেই। তিনি এক অশেষ কবিতার মধুর শেষ হবে না কখনো।

আসাদ ভাই, আপনার মৃত্যু নেই। অমরত্ব পান করেছেন আপনি। 

Link copied!