• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৫

গান গাইতে নজরুলের পাঁচ শর্ত ও এক চিঠি


তপন বাগচী
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২১, ০৫:৪৩ পিএম
গান গাইতে নজরুলের পাঁচ শর্ত ও এক চিঠি

শিল্পীরা যখন গান গাইতে যান, তখন আয়োজক পার্টির সঙ্গে মৌখিক আলোচনাতেও সম্মানী ও যাতায়াতের ব্যবস্থা ঠিক করা হয়। একসময় এই চুক্তি ছিল লিখিত ও পাকাপোক্ত। গ্রামাঞ্চলে যাত্রাগান, কবিগান, কীর্তন গানের শিল্পীদের সঙ্গেও লিখিত চুক্তি হতো, কত দিন গান গাইবে, প্রতিদিন কত টাকা সম্মানী দেওয়া হবে, যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে, সবই চুক্তি হতে। এখনো হয় চুক্তি, তা কেবল করপোরেট সেক্টরে। মূল শিল্পীর সঙ্গে চুক্তির হওয়ার রেওয়াজ মনে হয় কমেই গেছে। কাজী নজরুল ইসলামের ১৯৩৩ সালের একটি চিঠিতে এ রকম ৫টি শর্তে কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জে গান গাইতে আসার কথা বলা আছে।

নারায়ণগঞ্জ সংগীত-সংসদের অভ্যর্থনা-সমিতির সভাপতি নজরুলের কাছে কিছু শর্ত দিয়েছিলেন। সভাপতির নাম লেখা ছিল না চিঠিতে। তবে শর্তগুলো নজরুল পেয়েছিলেন কবি আজিজুল হাকিমের (১৯০৮-১৯৬২) মাধ্যমে। চিঠিটি লেখা হয় ১৯৩৩ সালের ২৩ আগস্ট, কলকাতার ৩৯ সতীনাথ রোড থেকে। এই কবির সঙ্গে ১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বিয়ে হয় সৈয়দা আসার খানমের (১৯০৫-১৯৮৫) সঙ্গে, নজরুল যাঁর নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ১৯২১ সালের ১৭ জুন। কিন্তু কাবিননামার শর্ত এবং অজ্ঞাত ও রহস্যজনক কিছু কারণে ওই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অসম্পূর্ণ রেখে রাত পোহানের আগেই নজরুল কনের বাড়ি অর্থাৎ আলী আকবর খানের কুমিল্লার দৌলতপুরের বাড়ি থেকে চলে আসেন। নজরুলের পথ চেয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে ১৯৩৮ সালে কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হয়। আজিজুল হাকিম ছিলেন নজরুলের স্নেহধন্য। তাঁর সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা ছিল। নারায়ণগঞ্জের গানের অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাই আজিজুলের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তাই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘শ্রীমান আজিজুল হাকিমের মারফত আপনাদের প্রস্তাবমতো নিম্নলিখিত শর্তে আমরা ছয়জন আর্টিস্ট নারায়ণগঞ্জ যাইতে রাজি হইয়াছি।’ কী ছিল সেই শর্ত।

প্রথম শর্তে ছিল ‘আপনি আমাদিগকে ১২০০ টাকা (বারো শত টাকা) দিবেন। ওই টাকায় আমরা নারায়ণগঞ্জে আগামী ১৪ই ও ১৫ই সেপ্টেম্বর দুই রাত্রি গান করিব’। এ থেকে সেই সময়ে কলকাতা থেকে একদল শিল্পী এসে গান গাইলে তাঁদের সম্মানী কেমন হবে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দুই রাত্রি গানের জন্য ১২ শত টাকা, মানে এক রাত্রির জন্য ৬০০ টাকা। সময়-বিচারে একেবারে কম নয় এই সম্মানীর পরিমাণ।

দ্বিতীয় শর্তে ছিল ‘আপনারা আগামী ১০ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্ধেক টাকা অর্থাৎ ৬০০ (ছয় শত টাকা) অগ্রিম পাঠাইয়া দিবেন এবং বাকি ছয় শত টাকা (৬০০) প্রথম রাত্রি অর্থাৎ ১৪ই সেপ্টেম্বর গান হইয়া যাইবার পরেই পরিশোধ করিবেন। ওই বাকি টাকা পাইলে তবে দ্বিতীয় রাত্রি আমরা গান করিবার জন্য বাধ্য থাকিব।’ অর্থাৎ অর্ধেক টাকা আগে হাতে পেয়ে শিল্পীরা গান গাইতে আসবেন। বাকি টাকা প্রথমে রাতের গানের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় রাতের গানের আগে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। এটি যে বাস্তব একটা যুক্তি, তা এখনকার গানের আয়োজনেও দেখতে পাওয়া যায়। সে পরিমাণ সম্মানী দেওয়ার কথা বলা হয়, গান শেষে তার আর খবর থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীদের ফেরার আয়োজনও করা থাকে না। নজরুলের আমলেও হয়তো তেমন অভিজ্ঞতা ছিল। তাই গান শেষ হওয়ার আগেই সম্মানীর পুরো টাকাটি তিনি চেয়েছেন।

তৃতীয় শর্তে ছিল ‘আপনি আমাদের যাওয়া-আসার সেকেন্ড ক্লাস ভাড়া দিবেন। পথে ও নারায়ণগঞ্জে খাওয়া-দাওয়ার সমস্ত খরচ আপনাকে বহন করিতে হইবে।’ এই শর্তটি বেশ মজার। শিল্পীদের টিকিটের ব্যবস্থা তো আয়োজকরাই করে থাকেন, তবু একেবারে পাকাপোক্ত কথাবার্তা নজরুল করতে চেয়েছেন। আর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন থাকা-খাওয়ার প্রসঙ্গটিও।

চতুর্থ শর্তটি আরও মজার। যে ছয়জন শিল্পী আসার কথা, তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পরিবর্তে অন্য শিল্পী নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটি মজার বলছি এই জন্য যে, নির্ধারিত ছয়জনের পরিবর্তে ভিন্ন ছয়জন হলে যদি আয়োজকগণ টাকা দিতে না চান, তাই আগেই নিশ্চিত করে আসতে চান নজরুল। এই শর্তের মাধ্যমে নজরুলের দূরদৃষ্টির পরিচয় মেলে।

পঞ্চম শর্তে রয়েছে চুক্তিভঙ্গের পরিণতির শর্ত। এটি হলো ‘আপনি যদি কোনো কারণে, আমাদের সহিত চুক্তি করিয়া সে চুক্তি ভঙ্গ করেন, তাহা হইলে আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। আমরা চুক্তি ভঙ্গ করিলে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকিব। ইহাই হইল মোটামুটি শর্ত। আপনার অন্য কোনো কিছু জানাইবার থাকিলে পত্র দিয়া জানাইবেন। আপনার সুবিধামতো অন্য তারিখেও,– অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে – আমাদের যাইতে আপত্তি নাই।’ এটি শর্ত পাঠ করে মনে হলো, সব দিকেই নজর ছিল। এটি সংগীতানুষ্ঠান এবং যেকোনো সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য একটি আদর্শ চুক্তিপত্র। ওই অনুষ্ঠানে শিল্পী হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র দে, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, নলিনীকান্ত সরকার, আব্বাসউদ্দীন আহমদ এবং কাজী নজরুল ইসলামের আসার কথা আর সঙ্গতিয়া বা তবলাবাদক হিসেবে রামবিহারী শীলের আসার কথা। এই যে ৫টি শর্তের কথা বলা হলো, তা যদি আয়োজক পার্টি মেনে নেন, তবে নজরুল শিল্পীদের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দেবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে নজরুল ‘অন্ধগায়ক’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ‘কানাকেষ্ট’ নামেও পরিচিত। শিল্পী মান্না দের গুরু এবং কাকা এই কৃষ্ণচন্দ্র দে। এই চিঠি সাক্ষ্য দেয় যে আব্বাসউদ্দীন আহমদও নজরুলের দলে গান গাইতে যেতেন।

এই চিঠিতে নজরুলের পাঁচ শর্ত কেবল তাঁর ব্যক্তিগত দলিল নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

Link copied!