দেবাশীষ দেব পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য অঙ্কনশিল্পী। বলা হয় দেবাশীষ দেবের তুলির টানেই নতুন করে প্রাণ পেয়েছে ওপার বাংলার কার্টুনশিল্প। কলকাতার নামকরা সব পত্রপত্রিকায় প্রখ্যাত সব লেখকের লেখা দেবাশীষ দেবের কার্টুন ও আঁকায় পেয়ে যায় ভিন্ন মাত্রা। শিশুদের জন্য এঁকেছেন, এঁকেছেন বড়দের জন্যও। লিখেছেন বইও। ‘রং তুলির সত্যজিৎ’ ও ‘আঁকায় লেখায় চার দশক’ দেবাশীষ দেবের দুটি চমৎকার বই। ১৪ অক্টোবর সংবাদ প্রকাশের ‘আমার ভুবন’ অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হয়ে আসেন। এ সময় তাঁর মুখোমুখি হন অঞ্জন আচার্য।
প্রশ্ন: আপনার আঁকাআঁকির শুরুটা কীভাবে?
উত্তর: আর্ট কলেজে যখন পড়তাম, তখন ছবি আঁকতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করার, অ্যাডভারটাইজমেন্ট এজেন্সিগুলোতে চাকরি নেওয়ার। এ জন্য আমি কমার্শিয়াল আর্ট নিয়ে পড়েছিলাম, যাকে বাংলায় বলে ব্যবহারিক কলা। এই কোর্স থেকে প্যাকেজিং বিজ্ঞপনের পেজ অ্যাড, এ ধরনের কাজ আমি শিখছিলাম এবং এ ধরনের কাজ করতে ভালোবাসতাম।
পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞাপনে কাজ করব, এ রকমই একটা ইচ্ছে আমার ছিল। কিন্তু পরের দিকে অ্যাসটেরিক্স, আমেরিকান ম্যাড ম্যাগাজিন এসব দেখতে দেখতে আমার কার্টুন বা ইলাস্ট্রেশনের ওপর একটা ঝোঁক তৈরি হয়। আমি ফোর্থ ইয়ারে পড়ার সময় থেকেই একটু কার্টুন, মজার ড্রইং একটু ইলাস্ট্রেশন এগুলো চেষ্টা করতাম।
পরে খাতায় আমার এ ধরনের স্কেচ দেখে আমার এক সিনিয়র আমাকে পাঠালেন সন্দেশের অফিসে (ছোটদের পত্রিকা, সম্পাদক ছিলেন সত্যজিৎ রায়, নলিনী দাস, লীলা মজুমদার)।
১৯৭৮ সালে প্রথম আমার আঁকা কিছু ছবি সত্যজিৎ রায়ের কাছে আমি পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে উনি আমার কাজ পছন্দ করেন এবং সেই বছর পুজো সংখ্যায় আমাকে তিনটি গল্পের ছবি আঁকতে দিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই থেকেই আমার ইলাস্ট্রেশনের দিকে আগ্রহ আরও বেড়ে গেল।
তারপর থেকে আমি বেশি বেশি কাজ করতে লাগলাম। একজন নবাগত হিসেবে আমার কাজ অনেকে পছন্দ করল। পরের বছর (১৯৭৯) আর্ট কলেজ থেকে পাস করার আগেই আনন্দবাজার পত্রিকা, নিউজ পেপার হাউস থেকে আমাকে ডেকে পাঠায়।
১৯৭৯ সালের ২ মে থেকে আনন্দবাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই এবং সেখানে একটানা ৩৭ বছর এই ইলাস্ট্রেশনের ওপরেই কাজ করেছি। বিশেষ করে ছোটদের ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায় আমি সব থেকে বেশি কাজ করেছি। যেহেতু ছোটদের ইলাস্ট্রেশনটা আমি ভালো পারতাম, যেটাকে বলে কমিক ইলাস্ট্রেশন। এ দিকটাতেই আমি বেশি পারদর্শী ছিলাম।
আস্তে আস্তে আমার কাজে আরও নতুনত্ব আসে। অবসরের পর এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকা, সময়িক পত্রিকা এমনকি অনলাইন পত্রিকাগুলোতে প্রচুর কার্টুন, কমিকস, ইলাস্ট্রেশনের কাজ করে চলেছি।
প্রশ্ন: আপনার আঁকা প্রথম প্রচ্ছদ প্রকাশিত হয় কত সালে?
উত্তর: আমি ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রচ্ছদ করি “গোসাই বাগানের ভূত” শীর্ষক বইয়ের। পাশাপাশি অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি ছোটদের ছড়ার সংগ্রহ “হট্টমালার দেশে” এই বইটির প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ইলাস্ট্রেশনের কাজ করি আমি।
প্রশ্ন: আপনার অধিকাংশ ইলাস্ট্রেশনে একটি ছোট্ট বিড়াল দেখা যায়, এই বিড়াল থাকার রহস্যটা কী?
উত্তর: আমি যখন আনন্দমেলা পত্রিকায় ছবি আঁকতাম, তখন আনন্দমেলার সম্পাদক ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি অত্যন্ত উদ্যমী এবং সফল একজন সম্পাদক ছিলেন। আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তিনি ছবি আঁকা, ইলাস্ট্রেশন এই ব্যাপারগুলোর ওপর জোর দিতেন। উনি আমাকে প্রথম বলেন, “ছবি যখন ইলাস্ট্রেশন করবি, তখন যত পারবি পোষা জন্তু-জানোয়ার ঢুকিয়ে দিবি ছবির মধ্যে। সেখানে লেখায় উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক।” এজন্য আমি আঁকার সময় একটা কুকুর, একটা বিড়াল, একটা খরগোশ, একটা পাখি, কাঠবিড়ালি এ ধরনের জন্তু-জানোয়ার আমার আঁকা ছবির মধ্যে রাখতাম।
আমার আঁকা প্রথম দিকের ছবিতে এই কুকুর ও বিড়াল সমানভাবে দেখবেন ছবির ফ্রেমের মধ্যে। কখনো একটা কুকুর তো অনেকগুলো কুকুর বা অনেক জায়গায় অনেকগুলো বিড়াল আবার কোথাও গাছের একটি পাখি।
শুধু যে বিড়াল দিয়ে ছবি আঁকব, এ রকম কোনো ভাবনা আমার প্রথম থেকে ছিল না। এটা সম্পূর্ণভাবে আমার যারা পাঠকবৃন্দ আছেন তারা একটা সময় ধরেই নিয়েছেন আমার ছবিতে কোনো না কোনো জায়গায় একটা বিড়ালের ছবি থাকবে। পরে দেখলাম আমার ছবির একটা নতুন ডাইমেনশন পেল এবং সেটা বিনা পরিশ্রমে। তারপর থেকেই মূলত আমি নিজেও ছবিতে বিড়াল ব্যবহার করি।
প্রশ্ন: আপনি তো প্রায় চার দশক ধরে পূজা সংখ্যাগুলোতে অলংকরণ বা প্রচ্ছদ করে আসছেন। চিত্রকল্পে একালের পূজা সংখ্যা এবং সেকালের পূজা সংখ্যার মধ্যে আপনি কোনো ফারাক দেখতে পান কি?
উত্তর: আমি ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে পুজোসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হই। তখন ছোটদের লেখকের যে গোষ্ঠী ছিল সেখানে সমরেশ বসু লিখছেন গোগলকে নিয়ে, সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছেন কাকাবাবু, বুদ্ধদেব গুহ লিখছেন জঙ্গলে বাঘ শিকার নিয়ে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একের পর এক সব অদ্ভুতুড়ে সিরিজ লিখে যাচ্ছেন। যার কথা সর্বাগ্রে বলতে হয় তিনি সত্যজিৎ রায়, কেউ ভাবতে পারবে না ফেলুদার জনপ্রিয়তা তখন কোন জায়গায় চলে গিয়েছিল। এমন একটা পাঠক পাওয়া যাবে না যে কিনা ‘শারদীয়া দেশ’ হাতে নিয়ে প্রথমেই ফেলুদা পড়েনি। ফেলুদার এই রকম জনপ্রিয়তা যে প্রত্যেক বছর পুজোর ঠিক আগে পাঠকদের মধ্যে একটা আলোচনা হতো, এবার পুজোয় ফেলুদা কোথায় যাচ্ছে। ফেলুদা কখনো কেদারনাথ, কখনো কাশ্মীর বা কখনো দার্জিলিং চলে যাচ্ছে। আমরা জানি ফেলুদাকে নিয়ে একটা গোয়েন্দা গল্প হবে কিন্তু তার সঙ্গে ফেলুদাকে কোথাও না কোথাও যেতে হবে। অর্থাৎ তার সঙ্গে একটা বেড়ানোর একটা মজা থাকবে। এগুলো আমরা ভীষণ উপভোগ করতাম।
প্রশ্ন: ‘রং তুলির সত্যজিৎ’ আপনার বহুল প্রশংসিত একটি কাজ। এই বইটি করার উৎসাহ পেলেন কেমন করে?
উত্তর: সত্যজিৎ রায়ের ইলাস্ট্রেশন তো বহুদিন ধরেই দেখছি। আমি যখন শিল্প সম্পর্কে বুঝতে শিখলাম তখন দেখলাম সবাই তাঁর সিনেমা নিয়ে যতটা কথা বলে, তাঁর আঁকা নিয়ে ততটা কথা বলে না। অথচ তাঁর আঁকা ইলাস্ট্রেশন, বুক কাভার সবই আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কোনো চর্চা হয় না।
তারপরে আমি সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর কাজগুলো জোগাড় করতে শুরু করি এবং বিশ্লেষণ করতে শুরু করি। তারপরে অনুষ্টুপ নামে একটা পুজো সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হলো ‘রং তুলির সত্যজিৎ’ নামে একটি প্রবন্ধ। পরবর্তী সময়ে আনন্দ থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয় আরও বিশদ আকারে। তখন সেটা আরও ছবি ও তথ্য দিয়ে বড় চেহারা দিলাম। বইটির এখন চতুর্থ মুদ্রণ চলছে।