• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বাংলাদেশের সিনেমার এক রাজপুত্রের গল্প


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৩, ০৯:২৯ এএম
বাংলাদেশের সিনেমার এক রাজপুত্রের গল্প

নায়ক ওয়াসিমের ট্রাজেডি নিয়ে কেন লেখা হলো না কোথাও সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। দুই ধরনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তিনি গেছেন। প্রথম ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতরে সব তারকাদেরই যায় সেটা হলো, নিজের অপরিহার্যতা ফুরিয়ে যাওয়া। আশির দশকের শেষ দিকে নায়ক ওয়াসিমের যারা ডিরেক্টর ছিলেন, যাদের পরিচালিত ছবিতে অভিনয় করে ওয়াসিমের একের পর ছবি বক্স অফিসে তুমুল ব্যবসা করেছে, তারা ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে গেলেন। আর নতুন ছেলেমেয়েরা আসলো, বলিউড থেকে ফ্রেম টু ফ্রেম কপি ‘চাঁদনী’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামতে’র মতো ছবি জয়জয়কার শুরু হলো। নতুন জুটি আসলো, নাঈম-শাবনাজ, সালমান শাহ-মৌসুমী কিংবা পুরোনোদের ভেতর ইলিয়াস জসিমের অ্যাকশন ইমোশনাল ছবিগুলো খুব চললো। নায়ক মান্নার সামাজিক অ্যাকশন চলা শুরু করলো। হারিয়ে গেল ওয়াসিমদের ফোক ফ্যান্টাসি টাইপ ছবি। ধীরে ধীরে ওয়াসিমও কাজ করা কমিয়ে দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে মন দিলেন।

এবার আসি দ্বিতীয় ট্রাজেডিতে। ২০০০ সালে তার স্ত্রী অকাল প্রয়াত হন। তার স্ত্রী ছিলেন অভিনেত্রী রোজী সামাদের বোন। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ২০০৬ সালে তার খুব আদরের মেয়ে ১৫-১৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়তো সেই মেয়েটি। নকলের অভিযোগ তার বাসায় জানানোর আগে তাকে খুব বাজেভাবে অপমানিত করা হয়। সেই গ্লানি নিয়ে স্কুলের বিল্ডিং থেকেই লাফ দেয় মেয়েটি। তার বড় ছেলে আইনজীবী। বার এট ল করেছে, বিদেশেই থাকতেন।

ওয়াসিম মোটামুটি নিঃসঙ্গ জীবন আর শারীরিক অসুস্থতা ও কিডনি জটিলতা নিয়ে কাটিয়েছেন অনেক দিন। কিছু ছবিতে নায়ক নায়িকার বাবার রোল ছাড়া আর তেমন বলার মতো কোনো ছবি তিনি করেননি শেষ কুড়ি বছর। পরিচালক প্রযোজকরাও তাকে নিয়ে ভাবেননি আর। তিনিও কাউকে ধরেননি ও মিডিয়াতেও অ্যাটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করেননি। দুই বছর আগে এইদিনে চলে যাওয়ার পর হুট করেই নায়ক ওয়াসিম নিয়ে অনেক চর্চা হয়। অথচ যে এফডিসির তিনি ছিলেন গোল্ডেন বয় সেখানেই তাকে নিয়ে আলাপ নাই। দেড়শো ছবি করেছেন ওয়াসিম। এর ভেতরে ৫০-৬০টা ছবি সুপারহিট। এর বাইরেও অনেকগুলো ছবি ব্যবসাসফল। শেষ বয়সে তিনি যখন ফরমাল স্যুট টাই প্যান্ট পরে ইন্টারভিউ দিতেন, মনেই হতো ‘নায়কোচিত’ আর কাকে বলে।

অধিক ফোক ও ফ্যান্টাসি টাইপ সিনেমা করার জন্য যেটা অনেকেই জানে না নায়ক ওয়াসিম খুবই একাডেমিক পড়াশোনা করা লোক। পাকিস্তান আমলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স মাস্টার্স করা। তিনি চার পাঁচ বার বডি বিল্ডিংয়ে মিস্টার পাকিস্তানের প্রতিযোগী ছিলেন। মিস্টার ইস্ট পাকিস্তানও হয়েছেন। সবার চোখেই ছিলেন সুদর্শন। সানগ্লাস আর শার্ট ও বেলবোটম প্যান্ট পরে ঘুরতেন, তার বাবাও যথেষ্ট বড়লোক ব্যবসায়ী, কখনও সিনেমা করবেন, ভাবেন নাই। একদিন হেঁটে যাচ্ছিলেন গুলিস্তান দিয়ে, দুই লোক এসে বলেন, “আমাদের বস আপনাকে ডাকে।” তিনি যেয়ে দেখলেন মহসীন সাহেব বসা। মহসীন বললেন, “এরকম এরকম একটা সিনেমা বানাবো, তোমাকে নিতে চাই।” ওয়াসিম ভাঁওতাবাজি মনে করে রাজি হলেন, তাকে নিয়ে গেল আহমদ জামান চৌধুরীর বোনের বাসায়। তিনি যাই বলেন তাই ওকে। চিত্রায়নেও তাই, এক টেকেই সব ওকে। ওনার এই প্রতিভা দেখে খুব খুশী সবাই। মহসীন সাহেবের এক ছবিতে অ্যাসিট্যান্টও ছিলেন তিনি। সিনেমার আগে ওয়াসিম কখনোই লুঙ্গি পরেননি, গ্রামেও থাকেননি। কিন্তু লম্বা কোর্তা, চকচকে-ভেলভেটি  রাজা বাদশাহর ড্রেস, ঘোড়ায় চড়া, এসবই হয়ে গেল তার বড়পর্দার আইডেন্টিটি!

সবমিলিয়ে ১৫২টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন ওয়াসিম। এদের মধ্যে সুপারহিট ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দ্য রেইন, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, দোস্ত দুশমন, মানসী, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, ইমান, রাতের পর দিন, আসামি হাজির, মিস লোলিতা, রাজ দুলারী, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন, জীবন সাথী, রাজনন্দিনী, রাজমহল, বিনি সুতার মালা, বানজারান। এসব ছবিতে ওয়াসিমের বিপরীতে ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক জনপ্রিয় নায়িকা। তাদের মধ্যে অলিভিয়া, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, কবরী, শাবানার সঙ্গে বেশি সংখ্যক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। প্রয়াত হবার দিনে তাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ।

Link copied!