• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ মুহররম ১৪৪৬

বাসু চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় ‘মিডল’ সিনেমার শেষ চলচ্চিত্রকার


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৩, ১০:০২ এএম
বাসু চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় ‘মিডল’ সিনেমার শেষ চলচ্চিত্রকার

বিখ্যাত পরিচালক রামগোপাল ভার্মার একটি বই পড়েছিলাম কিছুদিন আগে। নামটাও ওনার মতোই ‘গানস অ্যান্ড থাইস’। সেখানে বলেছিলেন এ গল্প। গল্পটা খুবই হতাশার। বাসু চ্যাটার্জি ২০০০ সালের দিকে হিন্দি ছবি বানানোর চিন্তা করলেন। প্রযোজক পেয়েছেন, রেডি স্ক্রিপ্টও। উনি রামগোপালের অফিসে যখন এলেন, পিয়ন তাকে চেনেনি; বলছে, এক বৃদ্ধ লোক এসেছে দেখা করবে, পরিচয় দিচ্ছে ডিরেক্টর। তিনি তখন এসেছেন মূলত মনোজ বাজপেয়িকে অভিনয় করাতে চান, ফোনে পাচ্ছেন না। রামগোপাল তো তাকে দেখে খুবই খুশি। ওনার শৈশবের প্রিয় ডিরেক্টর এসেছেন, যিনি ‘ছিচোড়’-এর মত সিনেমা বানিয়েছেন। ছোটি সি বাত, রজনীগন্ধা, খাট্টামিট্টা, পিয়া কা ঘারের মত বাণিজ্যিক সিনেমা বানিয়েছেন। রামগোপাল বললেন, “আচ্ছা আমি খোঁজ লাগাচ্ছি, মনোজ বাজপেয়ি শহরে নেই।” কিন্তু মনোজ বাজপেয়িকে আর পাওয়া গেল না অপেক্ষার পরও। বাসু যা বোঝার বুঝলেন, তিনি অনুরোধ করলেন অভিনেতা আফতাব শিবদাসানীকে দেখেন পারেন কিনা। আফতাব প্রথমত চিনতেই পারেননি বাসু চট্টোপাধ্যায়কে, পরে নিজে না এসে সেক্রেটারিকে পাঠালেন গল্প শুনে আসার, সেক্রেটারি আবার ১০ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবে না। বাসু ব্যর্থ মনোরথে রামগোপালকে বললেন, “যা বোঝার বুঝেছি, আমার আর সিনেমা করা হবে না।”

গল্পটা বলার কারণ, অতীতে আপনি যত সফল হন, কেউই মনে রাখবে না। সব অতীত মুছে দিয়ে ২০২০ সালের ৪ জুন চলে গিয়েছিলেন প্রথিতযশা ভারতীয় চলচ্চিত্রকার বাসু চট্টোপাধ্যায়।  

কিন্তু কী ছিলেন না বাসু চ্যাটার্জি। অসম্ভব প্রতিভাবান এক মানুষ। রাজস্থানে জন্মছিলেন সেই ১৯৩০ সালে। ফাইন আর্টসে পড়াশেনা করে এক জনপ্রিয় পত্রিকার কার্টুনিস্ট ও আর্ট এডিটর ছিলেন। কিন্তু এসব কিছুই আর তাকে টানেনি। সিনেমায় খুঁজে বেড়াতেন তার গল্প, সেটা বলার জায়গা কই? হৃষিকেশ মুখার্জি ও বসু ভট্টাচার্যের সহকারী ছিলেন। তারপরে শুরু করেন নিজের সিনেমা। সেই আমলের সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন। সারা আকাশ, ছোটি সি বাত, রজনীগন্ধা, ছিচোড়, শৌকিন, খাট্টামিঠা,  কমলা কি মওত, দুর্গা—কত সিনেমা করেছেন তিনি। বেশিরভাগ ছবিই ব্যবসা সফল। তার চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল মধ্যবিত্তের ছবি বানানো। তার গুরু বিমল রায় এবং হৃষিকেশ মুখার্জিদের মতো। মধ্যবিত্তের সুখ দুঃখ আর প্রেমের গল্পই ছিল তাদের সিনেমার বিষয়। সে সময় যে অ্যাকশন ছবির বাজার রমরমা ছিল, তার ছবি ছিল এসব এড়িয়ে। মিষ্টি সব গল্প আর শ্রুতিমধুর গান। কিছু ছবিতে আবার আসতো সেই সময়ের আধুনিকতা ও শহরের গল্প। সত্তর আশির দশকের এই ধারার শেষ ও সার্থক নক্ষত্র পরিচালক ছিলেন তিনি। ছয়টা ফিল্মফেয়ার ও একটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ও অনেকগুলো আজীবন সম্মাননা প্রমাণ করে তার কৃতিত্ব ও সফলতা।

বাসু চট্টোপাধ্যায়কে আমরা মনে রাখবো আরেক কারণে। যখন বাংলা সিনেমা মানেই ভায়োলেন্স আর অশ্লীলতার কেবল শুরু, তখন তিনি আমাদের জন্য বানিয়েছেন হাবিবুর রহমানের প্রযোজনায়, ‘হঠাৎ বৃষ্টি’। যদিও কাহিনী মৌলিক নয়, তবুও নব্বইয়ের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘হঠাৎ বৃষ্টি’। ফেরদৌস ও প্রিয়াঙ্কা অভিনীত এ ছবির গান ও গল্প ছিল মানুষের মুখে মুখে। টেলিভিশনে মুক্তি দেওয়া একটা ছবি, হলে এত ব্যবসা করবে সেটাই ছিল বিস্ময়কর। তারপর তিনি আমাদের জন্য বানিয়েছেন, ‘চুপিচুপি’, ‘হঠাৎ সেদিন’। এখনো টেলিভিশনে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ দেখতে বসলে হতাশ হবেন না। নচিকেতাকে দিয়ে সংগীত পরিচালনা ছিল মাস্টার স্ট্রোক। প্রথমে কথা ছিল অন্য শিল্পী গাইবে, নচিকেতা অনমনীয়, তিনি শুধু গাইবেন। বাসু চ্যাটার্জি অসাধারণ ম্যাজিক দিয়ে তিনি ছবিটা বানিয়ে ছিলেন। নায়ক ফেরদৌসের জীবন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল এক ছবিতে। অনেকদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ৪ জুন চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল ভারতীয় মধ্যবিত্ত কেন্দ্রীক প্রেম ভালোবাসার গল্পের সিনেমা বানানোর শেষ তারাটা।

Link copied!