১৯৭১ সাল। বর্বর পাকিস্তানি সেনারা খুন, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নীপিড়ন চালাচ্ছে বাংলাদেশে। জীবন বাঁচাতে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় হাজার হাজার মানুষ। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের এমন নির্মম অত্যাচার দেখে সহ্য করতে পারছিলেন না পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থান করলেও বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। সিদ্ধান্ত নিলেন একটি চ্যারিটি কনসার্ট আয়োজনের। সেখান থেকে যা অর্থ আসবে সব বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যার্থে দান করা হবে।
তখন তিনি ডাকলেন প্রিয় শিষ্য বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে। যদিও তত দিনে বিটলস ব্যান্ড ভেঙে গেছে। কিন্তু রবিশঙ্কর চাইছিলেন বিলটসের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে। ওস্তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন জর্জ। এবার ব্যান্ডের সব সদস্যদের একত্রিত করার পালা। সদস্যদের একত্রিত করা ও শিল্পীদের তালিকা বানাতেই লেগে গেল এক সপ্তাহ। তারপর কনসার্টের জন্য ১ আগস্ট তারিখ নির্ধারণ করা হলো।

কনসার্টের দিনটি ছিল রোববার। সেদিন প্রথমে একটি শো হওয়ার কথা থাকলেও দর্শক-শ্রোতা বেশি হওয়ায় দুটি শো করতে হয়। টিকিট কেটে দুই শোতেই ৪০ হাজারের মতো মানুষ অংশ নেয়। প্রথম শো শুরু হয় দুপুর আড়াইটায়, দ্বিতীয় শো রাত ৮টায়।
শুরুতেই দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি, আমরা শিল্পী। আমরা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুধু একটি বার্তাই পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সংগীত আপনাদের বাংলাদেশের মানুষের তীব্র বেদনা আর মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে সহায়তা করুক।”
কনসার্ট শুরু হয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর, সরোদবাদক আলী আকবর খান, তবলাবাদক আল্লা রাখা ও তানপুরাবাদক কমলা চক্রবর্তীর পরিবেশনা দিয়ে। তারা বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরে ‘বাংলা ধুন’ নামে একটি পরিবেশনা করেন। এরপর একে একে অন্য ব্যান্ডদলের বিখ্যাত শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। সেদিন অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান। ডিলানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল ও ট্যাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। অনুষ্ঠানে বিটলসের অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন।

একটি দেশের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের গায়কদের একত্রে এমন গান করার ইতিহাস নেই বললেই চলে। সেই অনুষ্ঠানে আটটি গান গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। সবার শেষে নিজের লেখা ও সুরে গাইলেন তাঁর কালজয়ী ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি।
পরবর্তীকালে এই কনসার্ট প্রসঙ্গে জর্জ হ্যারিসন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল রবিশঙ্করের পরিকল্পনা। সে কিছু একটা করতে চেয়েছিল। আমার সঙ্গে কথা বলে সে তার উদ্বেগের কথা জানায়। জানতে চায়, আমার কোনো পরামর্শ আছে কি-না। এরপর আমরা শো করার বিষয়টি নিয়ে অর্ধেক রাত পর্যন্ত কথা বলি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি অনুষ্ঠানটি করব। তখন অনেককে একত্র করার চেষ্টা করি। আমাকে কিছু জিনিস সংগঠিত করতে হয়েছিল; তার মধ্যে ছিল ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। আসলে এটাই। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সফলভাবে এর বাস্তবায়ন পর্যন্ত এই পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন করতে মাত্র চার সপ্তাহ সময় লেগেছিল।”

দুটি বেনিফিট কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ থেকে পাওয়া অর্থ প্রায় আড়াই লাখ ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রকাশিত হয় কনসার্টের লাইভ অ্যালবাম, যা রীতিমতো বিক্রির রেকর্ড গড়ে। একটি বক্স থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মসের তথ্যচিত্র ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্র আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে যা বেস্ট অ্যালবাম হিসেবে জিতে নেয় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড।
আজ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর ৫০ বছর পূর্ণ হলো। বাঙালি সত্তার সঙ্গে মিশে থাকবে সেই দিনটি। ভুলবে না পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের সাহায্যের কথা।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    




























