“আমার ছেলেকে ওরা গুলি করে মারল, আমার সোনার ছেলের কত স্বপ্ন ছিলো ওরা তা পূর্ণ করতে দিল না। ওই বিয়ে করবে, কত আশা করে বাড়ি বানাল কিন্তু বিয়ে করে বউকে আর আনতে পারল না। মেয়ে দেখেছি, আমার বাবাকে ধুমধাম করে বিয়ে দিবো, সেই আশা আর আমার পূরণ হলো না। ও তো দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরেছিল। ওর কী দোষ ছিল যে ওকে গুলি করে মারতে হবে?”
ছেলে হারিয়ে কান্না করতে এসব কথা বলে বিলাপ করছিলেন সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে নিহত দীপ্ত সাহার মা বিভা রানী সাহা।
বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপি মিটিং শেষে সেনা ও পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এসময় গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যান গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোর্ডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত দীপ্ত সাহার মা আরও বলেন, “আমার ছেলেরে যারা গুলি করে মেরেছে, সে যেন হাজার গুলি খেয়ে মরে। আমি যেন মরার আগে দেখে যেতে পারি আমার ছেলের হত্যাকারী হাজার গুলি খেয়ে মরেছে। তাহলে আমার আত্মা শান্তি পাবে।”
দীপ্ত সাহার ভাই সঞ্চয় সাহা শুভ বলেন, “আমার ভাই একজন ব্যবসায়ী। মারামারি বা গোলাগুলি শুরু হলে আমাদের চৌরঙ্গী রোডের চন্দ্রমুখী গার্মেন্টস বন্ধ করে বাসায় ফিরছিল। দীপ্ত চৌরঙ্গীর মিলন ফার্মেসির কাছে পৌঁছলে হঠাৎ ওর পেটের বাম পাশে গুলি লাগে। আমাকে রমেশ নামে একজন ফোন দিয়ে জানালে আমি হাসপালে গিয়ে দেখি ভাইকে অপারেশন থিয়েটারে নিচ্ছে। আমি ভাইকে বলি তুই ভালো হয়ে বাড়ি ফিরবি। ভয় করিস না। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর খবর আসে আমার ভাই আর বেঁচে নাই।”
তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “কী করবো যারা আমাদের রক্ষক তারাই যদি আমাদের মেরে ফেলে। এই বিচার কার কাছে দিব। বিচার চাওয়ার জায়গা আমাদের নাই। তাই ভগবানের কাছে বিচার চাই। এর যেন সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচার হয়।”
দীপ্ত সাহার বউদি তিথি সাহা বলেন, “বর্তমান সমাজে আমার দেবরের মত ছেলে পাওয়া খুবই কষ্ট। ভালোরাই এভাবে চলে যায়। কিন্তু গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যাবে এটাতো আমাদের কাম্য নয়। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।”
এদিকে গুলিতে নিহত শহরের বেদগ্রামের বাসিন্দা মো. ইদ্রিস মোল্লার ছেলে সোহেল মোল্লা। তিনি শহরের কেরামত আলী প্লাজায় মোবাইল ব্যবসায়ী। হই হুল্লো শুনে দোকান থেকে কিছু দূরে চৌরঙ্গীতে দেখতে যায়। সেখানে গিয়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে তিনটি গুলি এসে লাগে তার বুকে, পায়ে ও পেটে। এসব কথা বলেন সোহেলের বাবা ইদ্রিস মোল্লা।
সোহেলের মা লাইলী বেগম ছেলের মৃত্যু খবর শুনে শুধু কেঁদেই চলেছেন। কারও সাথে কোন কথা বলছেন না। সাংবাদিক দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আর চিৎকার করে সোহেলের নাম ধরে ডাকেন।
সোহেল ও নিশি বেগম দম্পত্তির দুটি ছেলে- রাইয়ান মোল্লা (৫) ও দেড় বছরের সোহান ইসলাম নিহান। সন্তানদের জড়িয়ে ধরে নিশি শুধুই কাঁদছেন আর বলছেন, ‘‘এদের আমি কী জবাব দিব। ওরাতো বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এদের আমি কীভাবে বাঁচাব? আল্লাহর কাছে শুধু বলি এই হত্যাকারীদের যেন এভাবেই মৃত্যু হয়।”
গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে সভা শেষে ফেরার পথে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গাড়িবহরে অওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও হামলাকারীদের ওপর গুলি চালায়। এ ঘটনায় চার জন নিহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলো জেলা শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে যুবলীগ সদস্য দীপ্ত সাহা (২৫), শহরের থানাপাড়ার কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (২৪), সদর উপজেলার আড়পাড়া এলাকার আজাদ তালুকদারের ছেলে ইমন তালুকদার (১৮), মিয়োপাড়া এলাকার ইদ্রিস আলী মোল্লার ছেলে সোহেল মোল্লা ও অটো চালক রমজান মুন্সী (৩২)।