চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার শুঁটকিপল্লিগুলোতে এ বছর কাঁচা মাছের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। হাতে গোনা দু-চারজন ব্যবসা শুরু করলেও বেশির ভাগ শুঁটকি ব্যবসায়ী এখনো ব্যবসা শুরুই করতে পারেননি। যারা ব্যবসা শুরু করেছেন, তাদের অধিকাংশই লোকসান গুনছেন।
প্রতিবছর ভাদ্র মাস থেকে এ এলাকায় সীমিত আকারে মাছ শুকানোর কাজ শুরু হয়। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মাছের জোগান। এ বছর আশ্বিন মাসের প্রথম দিকেই বিলগুলো প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিলের পানি কমে এলেও খুব একটা মাছ ধরা পড়ছে না। কিছু শুঁটকি ব্যবসায়ী সীমিত পরিসরে মাছ শুকানোর কাজ শুরু করলেও অনেকেই এখনো শুঁটকির চাতাল স্থাপন করেননি।
সরেজমিন চলনবিলের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ তথ্য।
শুঁটকির মৌসুম শুরু হলেও চলনবিল এলাকার শুঁটকিশ্রমিকদের ব্যস্ততা নেই। অন্যান্য বছর এ সময়ে সকাল থেকে রাত অবধি মাছ কেনা, ধোয়া, চাতালে শুকানো ও বাছাই করে পৃথক করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন চলনবিল এলাকার শত শত নারী ও পুরুষ শুঁটকিশ্রমিক।
চলনবিলের মাঝ দিয়ে নির্মিত বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে চলাচলের সময় মহিষলুটি এলাকা অতিক্রমকালে যে কারো নাকে লাগত শুঁটকি মাছের গন্ধ। এবার চিত্র ভিন্ন। মহিষলুটি ছাড়াও চলনবিলের আত্রাই, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, গুরুদাসপুর, সিংড়া, হালতী, লাহিরী মোহনপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মাছ শুকানো হলেও প্রায় সর্বত্রই চলছে মাছ সংকট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলনবিল এলাকার উল্লেখযোগ্য ৪৮টি বিল, ১৪টি খাল ও ১১টি নদীতে একসময় প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। জেলেরা বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার উপকরণের সাহায্যে মাছ ধরতেন। বর্ষাকালে মাছ ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দিতেন তারা। বর্ষার শেষ দিকে এসে উদ্বৃত্ত মাছ শুঁটকি করা হতো। উত্তরাঞ্চলের সৈয়দপুর, নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠানো হতো শুঁটকি মাছ।
কালের বিবর্তনে অনেক প্রজাতির মাছই এখন বিলুপ্তির পথে। মাছের প্রজাতি ও পরিমাণ কমে গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও এ এলাকার প্রায় এক শ শুঁটকি ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার শুঁটকিশ্রমিক মাছ শুকানোর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। কিন্তু মাছ শঙ্কটের কারণে এবার ব্যবসা শুরু করতে পারবেন কি না তা নিয়ে শঙ্কিত শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
প্রায় ২০ বছর ধরে চলনবিল এলাকায় শুঁটকি মাছের ব্যবসা করেন মহিষলুটি গ্রামের আলতাব হোসেন। তিনি বলেন, “অন্যান্য বছর ভাদ্র মাসেই আমাদের ব্যবসা পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। এ বছর কেবল মাত্র শুঁটকি চাতাল স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। বিলের পানি কমে আসছে। এ বছর মাছ কম, এটা নিশ্চিত তবে কতটা কম হবে, তা এখনি বলা যাচ্ছে না। মাছ কম হলে দাম বেশি হয়।”
আলতাব হোসেন আরও বলেন, “ভারতে চলনবিল এলাকার পুঁটি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নীলফামারী, সৈয়দপুর, রংপুরের মোকামে মাছ পাঠাতে আমাদের অনেক টাকা খরচ পড়ে যায়। মাছ সংরক্ষণের সুবিধায় সীমিত আকারে লবণ দেওয়া হয়। শুঁটকি মাছের ব্যবসা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। চলনবিল এলাকায় প্রক্রিয়াজাত করা শুঁটকি মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এবং কাছাকাছি বড় শুঁটকির মোকাম না থাকায় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
দেবীপুর গ্রামের শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী আজমল হোসেন জানান, বর্তমানে পুঁটি ও চাঁদা মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এ মাছগুলো ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি কিনছেন তারা। চার মণ মাছ শুকালে এক মণ শুঁটকি পাওয়া যায়। সৈয়দপুরের মোকামে পুঁটি ও চাঁদা মাছ আকার ভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত লোকসানে রয়েছেন তিনি।
মান্নান নগর এলাকার আরেক শুঁটকি ব্যবসায়ী আসলাম হোসেন জানান, বিলে মাছ নেই। চায়নাসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জাল দিয়ে বিল থেকে অধিকাংশ মা মাছ ধরে নেওয়া হয়েছে। ফলে কমেছে পোনা উৎপাদন। তাই মাছ সংকট এত তীব্র হয়েছে।
এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো মশগুল আজাদ বলেন, “এ বছর বর্ষা ও বৃষ্টির পানি কম হওয়ায় বিলের খোলা জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছের পরিমাণ কম হয়েছে। তবে পুকুরে চাষকৃত মাছের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে বেশি হবে আশা করছি।”