জিআই সনদ পেল সুন্দরবনের মধু, বদলাবে কি মৌয়ালের জীবন?


মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৫, ০৩:২০ পিএম
জিআই সনদ পেল সুন্দরবনের মধু, বদলাবে কি মৌয়ালের জীবন?
মধু নিয়ে যাচ্ছেন মৌয়ালরা। ছবি : প্রতিনিধি

বনের গা ঘেঁষে ভোরবেলা হাঁটছিলেন আলমগীর সরদার। চোখে ক্লান্তি, পিঠে বোঝা, আর মনে ভর করে থাকা বাবার স্মৃতি। বছর তেইশ আগে সুন্দরবনের গভীরে বাঘে মেরেছিল তার বাবাকে। সেই পথেই এখন হাঁটেন তিনি—মধুর খোঁজে, জীবিকার সন্ধানে। গায়ে নেই কোনো সুরক্ষা, হাতে ধোঁয়ার কলসি আর সাহস ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু আজ তাঁর চোখে এক চিলতে আনন্দ, কারণ এই প্রথমবার তার সংগ্রহ, তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোলা সোনালি তরল পেয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। সুন্দরবনের মধু এবার পেল ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ।

গত ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে—সুন্দরবনের মধু এখন আন্তর্জাতিক মানে স্বীকৃত একটি পণ্য। এই স্বীকৃতি শুধু মধুর মান নয়, বরং মৌয়ালদের জীবন, ইতিহাস ও সংগ্রামেরও স্বীকৃতি।

প্রতি বছর মোংলা, শরণখোলা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে ছয় হাজারেরও বেশি মৌয়াল নামেন বনে। বাঘ, নদী, সাপ আর ঝড়ের ভেতর দিয়ে তারা খুঁজে বেড়ান প্রাকৃতিক মৌচাক। এতদিন তাদের সংগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন থাকত—মধু কি খাঁটি? এখন সে প্রশ্নের আর জায়গা নেই।

মোংলার চাঁদপাইয়ের মৌয়াল আলমগীর বলেন, “বাজারে গিয়ে যখন শুনি, আমাদের মধু নাকি খাঁটি না, খুব কষ্ট লাগে। এই সনদ যদি সম্মান আনে, দাম বাড়ায়—তাহলে বাবা যেখানে আছেন, খুশি হবেন।”

বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অর্জিত এই জিআই সনদ দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন। ভারত অনেক আগেই তাদের অংশের সুন্দরবনের মধুকে এই স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর বাংলাদেশ ছিল বঞ্চিত। অবশেষে সেই শূন্যতা পূরণ হলো।

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, “এটা শুধু পরিবেশ নয়, মানুষ আর ন্যায়েরও জয়। এখন দরকার মৌয়ালদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা।”

সরকারি হিসাবে গত বছর সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করে রাজস্ব এসেছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি, কিন্তু মৌয়ালদের হাতে পৌঁছেছে তার সামান্যই।

মোংলার দিগরাজের রফিক শেখ ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, “জীবন রেখে মধু আনি, হাতে পাই দেনা আর হতাশা। যদি এবার কিছু বদলায়, মেয়েটার স্কুলটা অন্তত বন্ধ হবে না।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই স্বীকৃতিকে কাজে লাগাতে মান নিয়ন্ত্রণ, ব্র্যান্ডিং ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে এই সনদ থাকবে কাগজে, বাস্তবে নয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুস সাদাত বলেন, “সুন্দরবনের মধু যেন আবার কোনো রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থে বিকৃত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। কারণ এর পেছনে রয়েছে মানুষের রক্ত, ঘাম আর কান্না।”

সুন্দরবন ইউনিয়নের মতলুব আলী হাওলাদার বলেন, “মরার আগে যদি দেখি ছেলে ন্যায্য দামে মধু বিক্রি করতে পারে, তাহলে এই বনজ জীবনটাও অর্থহীন থাকবে না।”

ভৌগোলিক স্বীকৃতির এই নতুন সূর্যোদয় মৌয়ালদের জীবনে সত্যিকারের আলো আনবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ইতিহাসের পাতায় আজ একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো এমনই ধারণা করছেন সবাই।

স্বদেশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!