চট্টগ্রাম আদালতে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুরের পর তার অনুসারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয় জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে।
ঘটনার সময় আলিফের সঙ্গে ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট শহীদুল আলম রাহাত। মৃত্যুর আগে বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম। ঘটনাটি নিয়ে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস দেন শহীদুল আলম। পরে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শহীদুল আলম ঘটনার বিবরণ দিয়ে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ভাইয়া আমার পা মচকে গেছে। আমাকে নিয়ে যান!’ সাইফুল, ক্ষমা কইরো ভাই। তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো ঈমানী চেতনা আমাদের ছিল না। হায়েনাদের হাত থেকে তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।”
ওই স্ট্যাটাসে অ্যাডভোকেট শাপলা ইয়াসমিন নামের এক আইনজীবীর মন্তব্যের বিপরীতে শহীদুল আলম রাহাত আবার লেখেন, “অ্যাডভোকেটদের মধ্যে আমি সম্ভবত সাইফুলের সবচাইতে নিকটে ছিলাম। আমার দিকে হাত দেখিয়ে বলেছিল, ভাইয়া আমার পা মচকে গেছে। আমাকে নিয়ে যান। আমি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে তার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হায়েনাদের ইট, পাটকেল আর মুহুর্মুহু কাচ ভাঙার আঘাতের কারণে আমিসহ সবাই পেছনে সরে যাওয়ায় সাইফুল একলা হয়ে যায়। এই অবস্থায় সাইফুলকে স্পটে একা পেয়ে হ্যালমেট পড়া এক হায়েনা কুপিয়ে সাইফুলকে শহীদ করে। সাইফুলের ওই হাত আমাকে আজীবন ডাকবে।”
শহীদুল আলম রাহাত ২০১২ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। ২০১৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “ইসকনের অনুসারীরা হামলা চালিয়েছে। আমাদের ধারণা, তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরাও যোগ দিয়েছে। ঘটনার শুরু মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে। প্রিজন ভ্যান আটকে দেওয়া বিক্ষোভকারীদের সরানোর চেষ্টা করে পুলিশ ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে আদালত চত্বর থেকে পিছু হটে বিক্ষোভকারীরা। নেমে যাওয়ার সময় বিক্ষোভকারীরা কোর্ট বিল্ডিংয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ ও দোকানপাটে ভাঙচুর করে। এসময় তারা বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করে।”
শহীদুল আলম আরও বলেন, “এরপর তারা কোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রধান ফটকের আগে জড়ো হয়ে আইনজীবীদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেয়। সঙ্গে কিছু আইনজীবী এবং জনগণ অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীরা আদালতের প্রধান ফটকের বিপরীতে অর্থাৎ রঙ্গম হলের গলিতে ঢুকে যায়। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ৪ থেকে ৫ জন আইনজীবীসহ মোট ১৫ থেকে ২০ জন তাদেরকে ধাওয়া দিতে দিতে ওই সড়কের ভেতরে ঢুকে পড়ি। তখনো প্রধান সড়কে শতাধিক লোকজন ও আইনজীবী ছিলেন। সঙ্গে পুলিশও ছিল। ওরা তখন গলির ভেতর থেকে পাথর ছুড়ছিল। আমরাও তাদের পাথর ছুড়তে ছুড়তে ভেতরে পাঠিয়ে দেই।”
তিনি আরও বলেন, “কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের সংগ্রহে থাকা পাথর শেষ হয়ে যায়। তখন ওরা আমাদের লক্ষ্য করে পাথর এবং কাচ ভাঙা দিয়ে হামলা শুরু করে। তখন আমরা পিছু হটে যাই। এসময় আমি ও সাইফুলসহ মোট ৫ থেকে ৬ জন ছিলাম। একপর্যায়ে পা মচকে গিয়ে সাইফুল পড়ে যায়। তখন সাইফুল আমাকে উদ্দেশ্য করে বাঁচানোর আকুতি জানায়। কিন্তু উপর্যুপরি হামলার কারণে আমরা তাকে আর আনার সুযোগ পাইনি।”
হামলাকারীদের চেনেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গেঞ্জি ও হেলমেট পরা একজন লোক সবার আগে আক্রমণ শুরু করে। এরপর অন্যরা হামলা করে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া কাউকে আমি চিনি না। বিশেষ করে সামনের সারিতে যারা নেতৃত্ব দিছে ওইরকম কাউকে আমি চিনতে পারিনি। যদিও পরবর্তীতে আমরা ফুটেজে দেখেছি সাদা শার্ট পরিহিত কয়েকজন হামলা করেছে।”
অ্যাডভোকেট সাইফুলকে উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, “সাইফুলের ওপর হামলার কয়েক মিনিট পর আমরা পুনরায় লোকজন নিয়ে সাইফুলকে উদ্ধারে যাই। কিন্তু ততক্ষণে হামলাকারীদের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে সাইফুল অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।”
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে শহীদুল আলম বলেন, “পুলিশের ভূমিকা শুরু থেকে নিষ্ক্রিয় ছিল। সকাল থেকে পুলিশ সক্রিয় থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না।”
অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা। তার বাবার নাম জালাল উদ্দিন। তিনি ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবেও নিবন্ধন পান।
বুধবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তার প্রথম জানাজা চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দ্বিতীয় জানাজা বেলা ১২টার দিকে নগরের জমিয়তুল ফালাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বস্তরের জনসাধারণের ঢল নামে। জানাজা শেষে নগরের টাইগারপাস মোড়ে সমাবেশ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
এতে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং নাগরিক কমিটির সদস্য ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম।
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    




































