‘আমার তিনটা ছেলে। ৭ শতাংশ জমির মালিক। ৩ শতাংশ জমি রাস্তা করার জন্য ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু রাস্তা হচ্ছে না, বাড়ি থেকে বেরও হতে পারি না। খুব কষ্টে আছি। আমাদের যাতায়াতের জন্য এই রাস্তার বিশেষ প্রয়োজন। চোখে মুখে হতাশার ছাপ। খুব কষ্ট বুকে জমা করে কথাগুলা বলছিলেন ৬৭ বছরের বৃদ্ধা হাসিনা খাতুন।
তিনি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার বেতুয়ান গ্রামের ওহাবের মা। হাসিনা খাতুনের দাবি, শ্বশুর ও স্বামীর সময়ে রাস্তা পাইনি। মৃত্যুর আগে যদি রাস্তা পেতাম। আমার ছেলেরা ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে পারতো, তাহলে মরেও শান্তি পেতাম।
উত্তরপাড়া, বাওনজানপাড়া, চালাপাড়া, খাঁ পাড়া, নদী পাড়া, পূর্ব পাড়া, সরকার পাড়া, সুকনা পাড়া, দক্ষিণ পাড়া মিলেই এই বেতুয়ান গ্রামের অবস্থান। ৬ হাজার ভোটারের প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসতি এই গ্রামে। গ্রাম জুড়ে রয়েছে ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দুটি মাদরাসা, ১২টি মসজিদ, একটি মন্দির। রয়েছে ওয়ার্ড ভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক, গ্রামের মানুষের একমাত্র খেলাধুলার মাঠ ও ঈদগাঁ।
বেতুয়ান গ্রাম থেকেই তৈরি হয়েছে সচিব, জজ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, সেনাবাহিনীর মেজর, ক্যাপ্টেন, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, প্রকৌশলী, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। এই আলোকিত মানুষগুলো শুধুমাত্র রাস্তা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় আসতে পারেন না। তাদের বাড়িঘরগুলো সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। অথচ তারা এই রাস্তা নির্মাণের জন্য আর্থিকসহ নানা ভাবে সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন।
একটি পরিপূর্ণ গ্রামের যা থাকা দরকার সবই রয়েছে। কেবল গ্রামের ভেতরে চলাচলের নেই কোন রাস্তা। যুগযুগ ধরে এই ভোগান্তি চলে আসলেও গ্রামবাসী পায়নি একটি রাস্তা। নদীপাড় ঈদগা মাঠ হয়ে খেলার মাঠ ভায়া ওহাবের বাড়ি পাকা সড়ক পর্যন্ত ১৪০০ মিটারের এই যাতায়াতের পথ থেকে দীর্ঘকাল ধরেই বঞ্চিত হয়ে আসছে এ গ্রামের মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুগের পরিবর্তে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হওয়ায় এই গ্রামে সড়ক পথের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। গুমানী নদীতে প্রস্তাবিত ব্রিজটি নির্মাণ হলে এটি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, মোহনপুর, জৈন্তিহার, সুজা, পরিন্দ্ররপুর, এরশাদনগর বাজার, দিলপাশার, লক্ষ্মীকোল, আদর্শ গ্রামসহ ব্যাপক জনগোষ্ঠির চলাচলের একমাত্র রাস্তা হবে বেতুয়ান গ্রামের দাবিকৃত এই রাস্তাটি।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় গ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী, রিপন সরকার, জয়নুল আবেদীন, জিয়াউর রহমান, জাহিদ খান, আইয়ুব আলীসহ কমপক্ষে অর্ধশত মানুষের সঙ্গে। মানুষের বাড়ির উপর দিয়ে, উঠান ও বাহিরবাড়ির আঙিনা দিয়ে যাতায়াত করতে হয় গ্রামের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের। বকাঝকা, গালমন্দ, মুখকালোসহ নানা ধরণের অশোভনীয় আচরণের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। অর্থবিত্তে তাদের কমতি নেই। আছে সামাজিক মর্যাদা। কেবল একটি যাতায়াতের রাস্তার জন্যই বাড়িওয়ালাদের কাছে ছোট হতে হয়। এ লজ্জা কোথায় রাখব। চোখ বন্ধু করে মুখ আটকে এগুলো হজম করতে হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আক্কাস আলী ও রঞ্জ হোসেন বলেন, একজন মানুষ মারা গেলে তার খাটিয়ায় নিয়ে গোরস্থানে নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বৃদ্ধ ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী বা একজন বৃদ্ধ মানুষের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার মতো কোন পথ নেই। অনেক কষ্ট করে অনেক সময় ব্যয় করে তাদের সেই জায়গায় নেয়াও দুরুহ হয়ে যায়।
বেতুয়ান গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ফরিদুল ইসলাম বলেন, এই গ্রামের নেই কোনো রাস্তা। মাঠের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক। রোগীকে আসতে হবে অন্যের জমির আইল দিয়ে। গ্রামের নিজস্ব রাস্তা হলে রোগীদের আসতে এই সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, বৃষ্টি বা বর্ষা মওসুমে কাঁদা ও হাটু পানি পাড়ি দিয়ে রোগীদের আসতে হয় শুধুমাত্র চলাচলের রাস্তা না থাকায়।
বেতুয়ান পূর্বদক্ষিণ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলেয়া বেগম বলেন, স্কুলটিতে শিক্ষার্থীদের আসার কোনো পথ নেই। অন্যের ফসলি জমি দিয়ে আসতে হয়। বৃষ্টি বা বর্ষা মওসুমে শিক্ষার্থীদের ক্লাস মুখি করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি একটি ভোট কেন্দ্র। অথচ নির্বাচন যায় আসে। ভোটের জন্য প্রার্থীরা আসলেও নির্বাচন চলে যাওয়ার পর তারা ভুলে যায় এই প্রতিষ্ঠানটির কথা। একটি রাস্তার বিশেষ প্রয়োজন এমন দাবি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দের।
স্থানীয় বাসিন্দা ডা. মো. জাকারিয়া মানিক বলেন, শুধুমাত্র একটি যাতায়াতের পথ পাল্টে দিতে পারে এই গ্রামের সার্বিক চিত্র। সকল সুবিধা, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থসামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করছে একটি মাত্র রাস্তার জন্য। সব কিছুই যেন আটকে আছে একটি রাস্তার অভাবে। সরকারের প্রজ্ঞাপনে আছে জনগণের সুবিধা বিবেচনায় খাল-বিল-নালা ভরাট করে যাতায়াতের পথ তৈরি করা। অথচ যুগের পর যুগ সরকারি হালট (রাস্তা) থাকা শর্তেও আমরা গ্রামবাসী রাস্তা থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছি।
দিলপাশার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অশোক কুমার ঘোষ প্রণো বলেন, একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে অনুভব করি না, একজন গ্রামবাসী হিসেবে অনুভব করি একটি যাতায়াতের রাস্তার কতটা প্রয়োজন। এই রাস্তা নির্মাণের জন্য দুটি প্রকল্প দেয়া হয়েছে। অথচ স্থানীয় কিছু ষড়যন্ত্রকারী রাস্তা নির্মাণের বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। স্থানীয় এমপি সাহেবও প্রকল্প দিয়েছেন গ্রামের বৃহত্তর স্বার্থে। কিন্তু আইনী জটিলতার কারণে আটকে আছে এই গ্রামের মানুষের যাতায়াতের এই পথটি। তিনি সরকার বাহাদুরের কাছে গ্রামবাসীর জনদূর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবী জানান।
এ ব্যাপারে ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আশরাফউজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেতুয়ান গ্রামবাসীর যোগাযোগের জন্য রাস্তাটি খুবই জরুরি। কিন্তু তারা যেখানে রাস্তা করছিল সেখানে সরকারের জলাশ্রেণির জায়গা ছিল। ওই জলা ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের অনুমতি বা শ্রেণি পরিবর্তনের কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই। মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। তাছাড়াও স্থানীয় একটি মহল ওই কাজ বন্ধের জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেওয়ায় যারা কাজ করছিলেন তাদের সহযোগিতায় আমরা সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। অভিযোগকারীরা উচ্চ আদালত থেকে উকিল নোটিশও দিয়েছিল জেলা প্রশাসক, ইউএনও, কমিশনারসহ কয়েকজনকে। তারও জবাব আমাদের দিতে হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আলোচনা চলছে। হয়তো সঠিক সমাধাণের পথ সৃষ্টি হবে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বাকিবিল্লাহ বলেন, এই গ্রামের মানুষ নিজ উদ্যোগে বিপুল পরিমান অর্থ খরচ করে রাস্তা তৈরীর কাজ শুরু করেছিল। যা দেশের একটি নজির বিহীন ঘটনা। স্থানীয় গুটি সংখ্যক মানুষের অপতৎপরতার কারণে কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আমি জোড়ালো ভাবে চাই এই রাস্তাটি হোক। এই রাস্তা নির্মাণের জন্য আমার সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আশা করছি এটি খুব দ্রুত নিরশন হবে।
পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য, ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মো. মকবুল হোসেন বলেন, আমি রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রকল্প দিয়েছিলাম। কিন্তু রেকর্ডে জলা থাকায় সরকারি কোন বরাদ্দ দেয়ার নিয়ম না থাকায় সেটা ফেরত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শ্রেণি পরিবর্তন করা না হলে কোন কাজ করা সম্ভব নয়। তবে গ্রামের মানুষ যদি তদবির করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত নিতে পারে তাহলে আমি বিষয়টি নিয়ে আগাতে পারবো। তিনি আরও বলেন, গ্রামবাসীর রাস্তাটি বিশেষ প্রয়োজন এটা আমি ভালো করেই জানি। এ জন্য তারা নিজ উদ্যোগে খাল ও হালট ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরুও করেছিল। কিন্তু গ্রামে কতিপয় মানুষের খারাপ চিন্তাচেতনার কারণে সেই কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাস্তা তৈরীর ব্যাপারে আমার আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই।