• ঢাকা
  • শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৫ জ্বিলকদ ১৪৪৬
পাবনা মানসিক হাসপাতাল

চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত চিকিৎসাসেবা


আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২১, ০৮:৪৮ এএম
চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত চিকিৎসাসেবা

দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই বিশেষায়িত হাসপাতালটি। প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া আসলেও নানা সমস্যার কারণে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত ভুক্তভোগীরা। হাসপাতাল প্রশাসন চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটের বিষয়টি বারবার প্রাধান্য দিয়েছেন। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০০ রোগী ও স্বজনদের আনাগোনা থাকে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের আউটডোরে। পুরাতন জীর্ণ একটি ভবনেই চলছে প্রাথমিক রোগী বাছাই ও জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদান কার্যক্রম। ঝড়ো হাওয়া বা বৃষ্টির সময় আসা রোগী ও তার স্বজনদের আশ্রয়ের জন্য নেই কোন নির্ধারিত স্থান।  

রোগীর স্বজনদের দাবী, অল্প জায়গাতে অনেক বেশি লোক সমাগম হওয়ায় বর্তমান করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি আর ঠেলাঠেলিতে ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি হয়। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম আরো বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। 

আগত মানুষগুলোর তত্ত্বাবধানে থাকা আনসার সদস্যদের রুঢ় আচরণে রোগীর স্বজনেরা অনেকেই বিব্রত। তাদের সঙ্গে চলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ব্যবহার। গোপনে কিছু অর্থ হাতে ধরিয়ে দিলেই খুব সহজেই জরুরি বিভাগের টিকিট পাওয়া ও ডাক্তার দেখানো সম্ভব বলে অভিযোগ রোগীর সাথে আসা স্বজনদের। 

নাটোর, কুষ্টিয়া, রংপুর, রাজবাড়ি, সিরাজগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে আগত মানসিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, রোগী দেখাতে এসে নানা হয়রানীর শিকার হতে হয়। শহরের পৈলানপুর থেকে কাশিপুর মোড় এবং হাসপাতালের মেইন গেটের ভেতর পর্যন্ত চলে দালালদের অবাধ দৌরাত্ম। এই দালালদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে স্থানীয় অটোবাইক চালক ও আনসার সদস্যদের। 

হাসপাতালের ইনডোরে বেশ কয়েকটি পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড ঘুরে কথা হয় দায়িত্বরত নার্স, সুপারভাইজার ও চিকিৎসা নিতে এসে ভর্তি হওয়া নারী-পুরুষ রোগীদের সঙ্গে। নারী ওয়ার্ডে কথা হয় নেত্রকোনার রোখসানা খাতুনের (৩৭) সাথে। তিনি বলেন, নার্সরা আন্তরিক। তারা তার পিতা-মাতা, ভাই-বোনের মতো। এখন সে সুস্থ। তাহলে কেন তার পরিবার নিয়ে যাচ্ছে না। সে বাড়ি যেতে চায়। তারা তো সবাই এসে তার সাথে সাক্ষাত করে। তাহলে বাড়ি নিতে সমস্যা কোথায়? 

নারী ওয়ার্ডের সুপারভাইজার রাশেদা খাতুন বলেন, এদের সন্তানের মতো লালনপালন করতে হয়। এরা যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তখন খারাপ লাগে। ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে কেউ কেউ খারাপ আচরণ ও মারধরও করে। তারপরও ওদের সকল জ্বালা সহ্য করে ওদের পাশেই রয়েছি। 

কয়েকটি পুরুষ ওয়ার্ড ঘুরে দেখার পর ৫ নং ওয়ার্ডে কথা হয় পাবনার মোক্তাহিদ ইকবালের (২২) সাথে। তার কাছে নার্স, সেবা সবকিছুই ভালো লেগেছে। কিন্তু তাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে লোহার খাঁচা বন্দি করে। এটাই তার প্রশ্ন। সে বাড়ি ফিরতে চায়। বাবা মার সাথে থাকতে চায়। 

পুরুষ ওয়ার্ডের নার্সিং সুপারভাইজার আব্দুল কাদের বলেন, পুরুষ ওয়ার্ডে পুরুষ নার্স বেশ সংকট। কিছু সংখ্যক নার্স দিয়ে চালানো হচ্ছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পুরুষ রোগীরা। পুরুষ রোগীদের সব কাজ তো নারী নার্স দিয়ে করানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মেয়েদের চেয়ে ছেলে রোগীগুলো কিছুটা উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক হওয়ায় নারী নার্সরা এগিয়ে যেতে সাহস পান না। এ জন্য পুরুষ নার্স বিশেষ প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, মানসিক রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। এ জন্য ঝুঁকি ভাতা চালু করার দাবী জানান তিনি।   

মানসিক রোগীদের নার্সিংয়ের বিষয়ে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ নার্সের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, তিন শিফটে তারা ডিউটি করেন। সকাল শিফটে নার্সের সংখ্যা কিছুটা বেশি থাকে। দুপুরে কমতে থাকে। আর রাতে একেবারেই কম নার্স দিয়ে ডিউটি করানো হয়। বিশেষ করে নারী নার্সের চেয়ে পুরুষ নার্সের বিশেষ প্রয়োজন সেবা দেয়ার জন্য পুরুষ ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড প্রতি যে পরিমাণ নার্স প্রয়োজন তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে চালানো হয়।

মানসিক রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত একাধিক চিকিৎসকের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, আউটডোরে জরুরি বিভাগে রোগী দেখার সময়ে খবর আসে ইনডোরে রোগীর খারাপ অবস্থা। তখন আউটডোরের রোগী দেখা বাদ দিয়ে ইনডোরে আসলে অনেকটা চাপের মধ্যেই পড়ে থাকতে হয়। অল্প সংখ্যক চিকিৎসকের কারণে সন্তোষজনক চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। 

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মো. মাসুদ রানা সরকার জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক প্রয়োজন। অথচ ৩ জন সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে এই হাসপাতালের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজন চিকিৎসক পাবনা মেডিকেল কলেজের। চিকিৎসক সংকট দূর হলে অবশ্যই রোগীকে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব। 

আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. শাহীন রেজা বলেন, ৫০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও অনেক সংকট রয়েছে। এই সংকটের মধ্যেই আমরা সমস্যা নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে সংকট নিরসন হলে অবশ্যই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতন কুমার রায় বললেন, যতটুকু আছে সেটুকু দিয়েই ভাল মানের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। সংকট নিরসনে ডিসি অফিসের মিটিং এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। আশা করছি সরকার এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মানের করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সেটি বাস্তবায়ন হলে চিকিৎসা সেবার মান আরও বৃদ্ধি পাবে। 

হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্যর বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক বলেন, “আমরা অনেক বলেছি। কাজ হয় না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিষয়টি জানানো হয়। তারা মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে দালালদের আটক করলেও রাজনৈতিক তদবির, স্থানীয় আধিপত্য আর প্রভাবশালীদের কারণে ছেড়ে দেওয়া হয়।”

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে মোট পদের সংখ্যা ৬৪৩টি। মঞ্জুরি পদ রয়েছে ৪৪৭টি, আর শূন্য পদের সংখ্যা ১৯৯টি। চিকিৎসকের পদ ২০, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদ ৩টি, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার পদ ১টি, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ ২১টি ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ১০০টি পদ শূন্য রয়েছে। 
 

Link copied!