শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিককে বিচারপতি নয়, ‘বিচারক’ বলতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী একমাত্র প্রধান বিচারপতি ছাড়া বাকি কেউই বিচারপতি নন। সবাই বিচারক। তাতে তিনি হাইকোর্টের বিচারক হোন কিংবা আপিল বিভাগের।
এ কথা সম্প্রতি চ্যানেল আই স্টুডিওর একটি ভিডিও প্রকাশের পরেও লিখেছিলাম। আবার মনে করিয়ে দিলাম।
তবে বিচারক কি বিচারপতি, সেটি বড় কথা নয়। কেননা, উচ্চ আদালতের একজন বিচারককে কেউ যদি সম্মান করে বিচারপতি বলেন, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই ভদ্রলোকের সমস্যা হলো, তিনি ‘বিচারপতি’ শব্দটিকে নিজের নামের অংশ ভাবেন এবং তার নামের আগে বিচারপতি না বললে বা না লিখলে তিনি মাইন্ড করেন। খারাপ আচরণ করেন। আমি ওনার সাথে মাত্র দুটি শো করেছিলাম। অসম্মানিত হওয়ার ভয়ে সেখানেও তাকে ‘বিচারপতি’ বলেই সম্বোধন করেছি।
আপনাদের মনে থাকার কথা, ২০১২ সালের ১৪ মে শামসুদ্দিন চৌধুরী ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন সড়ক ভবনের একটি অংশ এবং দুটি কক্ষ সুপ্রিম কোর্টকে হস্তান্তর করার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এ আদেশের বিষয়টি সংসদে উত্থাপিত হলে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ ২৯ মে সংসদে বলেন, “দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে, আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।”
এর প্রতিক্রিয়ায় ৫ জুন হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ স্পিকারের এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন এবং স্পিকারের বক্তব্যেকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক’ বলে অভিহিত করেন। এমনকি এই বক্তব্যের কারণে স্পিকারের পদে থাকার অধিকার নেই বলেও হাইকোর্ট মন্তব্য করেন।
আদালতের এই মন্তব্যের পর ওই দিন সন্ধ্যায় সংসদে শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সরকারদলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য। তারা শামসুদ্দীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানান। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শামসুদ্দীন চৌধুরীকে ‘স্যাডিস্ট’ (যারা অন্যকে কষ্ট দিয়ে বা অসম্মান করে বিকৃত আনন্দ পায়) বলে মন্তব্য করেন। ওই দিন সংসদের বৈঠক আমিই কাভার করেছিলাম। ফলে পুরো ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে।
এই একটি লোকের কারণে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী এনে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। অর্থাৎ একজন লোকের কারণে সংবিধানে পর্যন্ত সংশোধনী আনা হয়েছিল।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তার স্বাক্ষরেই এই মানিক সাহেব আপিল বিভাগের বিচারক নিযুক্ত হন। আবার যাকে নিয়ে সংসদে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সদস্যরাই তুমুল সমালোচনা করলেন; যার কারণে সংবিধানে সংশোধনী আনতে হলো- অবসরে যাওয়ার পরে তিনিই হয়ে উঠলেন আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাংক। কথায় কথায় যাকে তাকে ‘রাজাকার’ বলাটা তার একটি বদঅভ্যাসে পরিণত হয়। নিজের মতের সঙ্গে না মিললে কিংবা তাকে পর্যাপ্ত সম্মান দেওয়া হয়নি মনে করলেই তিনি ক্ষেপে যান। অবস্থা এমন হয় যে, তাকে সাংবাদিকরাও ভয় পাওয়া শুরু করেন, শুধুমাত্র তার আচরণের কারণে।
সেই লোকটির আজ এই পরিণতি!
অহংকার, দম্ভ, মানুষকে হেয় করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার শাস্তি সব সময় পৃথিবীতে হয় না। কিন্তু কারো কারো শাস্তি পৃথিবীতেই হয়ে যায়।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারকের এই পরিণতি কোনো ভালো উদাহরণ নয়। সত্যি বলতে কি, ওনাকে আটক করার যে ভিডিওটি আপনিও এরই মধ্যে দেখে ফেলেছেন, সেটি যে একজন বিচারকের বা বিচারপতির—এটি ভাবতেও কষ্ট হয়।
এখন যারা বিচারকের আসনে আছেন, এ ঘটনা তাদের সবার জন্যই একটি বড় শিক্ষা।
আমীন আল রশীদ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































