• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ও পুতিনের ভূমিকা


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৩, ০২:১৩ পিএম
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ও পুতিনের ভূমিকা

রাশিয়াতে বসেই ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে অংশ নিচ্ছেন। জি-২০ সম্মেলন, জি-৭ সম্মেলন, ব্রিকস সম্মেলন সবগুলোতেই তার অংশগ্রহণ সশরীরে না হলেও উল্লেখযোগ্যভাবেই হয়েছে। সম্প্রতি কৃষ্ণসাগরের অবকাশযাপন কেন্দ্র সোচিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের সঙ্গে নিরাপদে ইউক্রেনের শস্য বিশ্বে সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর খাদ্যশস্য চুক্তির বিষয়টির গুরুত্ব এখনও কতটা তা হয়তো এই বৈঠকের কল্যাণে আন্তর্জাতিক মহল ঠাহর করতে পারছে। তবে তাদের এই বৈঠকের সময় দুটো খবর আমাদের অবাক না করে পারে না। প্রথমত উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের সঙ্গে পুতিনের সফরের খবরটি আর দ্বিতীয়ত ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের সফলতাকে অস্বীকার করা। প্রথম খবরের বিষয়টি অবশ্য ক্রেমলিন অস্বীকার করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো একটি পত্রিকা কোনো সূত্র ছাড়াই এমন একটি খবর ফাঁস করবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে ক্রেমলিন তা অস্বীকার করছে। যেমনটা তারা ইয়েভজেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর বিষয়ে করেছে।

কীভাবে বা কেন প্রিগোশিন মারা গেছেন সে কথা আমাদের পক্ষে আর জানা সম্ভব নয়। অনেকের ধারণা তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রিগোশিনকে মারার পেছনে পুতিন দায়ী, নাকি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ দায়ী; এ নিয়ে আমরা এখনও বিস্তর তর্ক চালিয়ে যেতে পারি। তবে প্রিগোশিনের  মৃত্যুর পর অল্প কদিনেই বিষয়টি আর অত গুরুত্বপূর্ণ নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর ধারণা, সামরিক বাহিনী ও রাশিয়ার অভিজাত সমাজের মনে ভয় সঞ্চার করতেই পুতিন পথ থেকে প্রিগোশিনকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার অনেকের মতে, এই গুপ্তহত্যা (যদি বলা যায়) রাশিয়ার অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের অবয়ব স্পষ্ট করে তুলেছে। তাদের এ মতামতকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। কিন্তু তাদের এ অনুমান রাশিয়ার অভ্যন্তরে একাধিক শঙ্কা কিংবা উদ্বেগের বিষয় এড়িয়ে যায়। আর এ শঙ্কার অংশ রাশিয়ার নাগরিক। অর্থাৎ ভ্লাদিমির পুতিন বা ক্রেমলিন যা বক্তব্যই দিচ্ছেন তা মূলত রাশিয়ার নাগরিকদের সন্তুষ্ট রাখার উদ্দেশ্যেই। তারা যেন আতঙ্কিত না হয়। কারণ প্রিগোশিনের বিদ্রোহ থেকেই রাশিয়ার মানুষের মনের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট আকার পেতে শুরু করেছিল। এই যুদ্ধ তারা চায়নি। পুতিন নিজেই এই যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।

রাশিয়ার চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির নাগরিকদের জীবনে প্রভাব ফেলবে। যেমন, তাদের রাষ্ট্র যুদ্ধে হেরে যাবে, যুদ্ধের কারণে চারদিকে ভয়াবহ পরিস্থিতি যেকোনো মুহূর্তে গড়ে উঠতে পারে, ইত্যাদি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই ফিউড ও প্রিগোশিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মীমাংসা করার ব্যাপারে পুতিনের অনাগ্রহ জনমনে উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়েছে। তাদের এ দ্বন্দ্ব যদি চূড়ান্ত মাত্রা পেত তাহলে রাশিয়া অবধারিতভাবে ইউক্রেনের কাছে যুদ্ধে হারতে পারত। আপাতত যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহতা কি আরও বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে? নানা জটিলতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এর পরিণতি নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা যাচাই করে অনুমান করা যায়, রাশিয়া যদি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দেয় তাহলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তারা কিছুটা সহযোগিতা পাবে। রাষ্ট্রের একতাই এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করবে। রাশিয়ার অভিজাত বা সাধারণ মানুষের কেউ এ যুদ্ধ চেয়েছে বলে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রমাণ নেই। ইউক্রেন হামলার সিদ্ধান্ত একান্তই পুতিনের। তার পরও সাধারণ মানুষ চায় না এ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করুক। আর এসপার বা ওসপার কোনোটিই নয়, এমন জাতিগত মনোভাবনা একাধিক সমস্যা তৈরি করে। আপাতত এ যুদ্ধ থামানোর পক্ষে তাদের যুক্তি কোথায়? প্রতিদিন রাশিয়ান সেনারা মৃত্যুবরণ করছে। আর ইউক্রেনের কাছে বড় পরাজয়েরও শঙ্কা রয়েছে। তাই যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষেও রায় দেওয়া যায় না। অভিজাতরা মূলত যুদ্ধে পরাজয়-পরবর্তী অরাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে আতঙ্কিত। সাধারণ মানুষও রাজ্যশাসনে স্থিতিশীলতা হারানোর ভয় থেকে মুক্ত নয়। এই যুদ্ধে পরাজয় পুতিনের শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে দেবে। আর এ পরাজয় রাশিয়ার একতা ধ্বংস করতে পারে। পুতিনের সামনে ঝুলছে অনেক প্রশ্ন।

এ তো গেল একটি দিক। কিন্তু কৃষ্ণসাগর খাদ্যশস্যচুক্তির বিষয়টি তবে কী? সম্ভবত রাশিয়ার শীর্ষ নেতা খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। সারা বিশ্বেই খাদ্যসংকট একটি বড় সমস্যা হিসেবে জিইয়ে আছে। এই সময়ে খাদ্য সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেওয়াও একটি বড় কৌশল হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইউক্রেন থেকে শস্য বিশ্ববাজারে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের আগেও ইউক্রেনে উৎপাদিত ৯০ শতাংশ খাদ্যশস্য কৃষ্ণসাগরের মাধ্যমে অন্যান্য জায়গায় সরবরাহ করা হতো। তাদের রপ্তানি টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই এই বন্দরগুলো জরুরি ছিল। হ্যাঁ, ইউক্রেন স্থলপথে তাদের খাদ্যশস্য ইউরোপে সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তাই কৃষ্ণসাগরের মাধ্যমে খাদ্যশস্য পাঠাতে পারলেই লাভের পাল্লা ভারী হবে বেশি। স্থলপথে সরবরাহ ব্যয় অনেক বাড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধাবস্থা একটি বড় কারণ অবশ্যই। তা ছাড়া কৃষিব্যবস্থার ধস এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা ইউক্রেনের পীঠ অনেকটাই ঠেকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ চুক্তি বাতিল করলে ইউক্রেনের অর্থনীতির জন্য সেটি একটি বড় হুমকি অবশ্যই। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে গম, ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আফ্রিকায় খাদ্যসংকটের বিষয়টিও নতুন কিছু নয়। সমস্যা বেড়ে চলছে। এমন সময়ে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুতিনের এই রাজনীতি জটিল আকার ধারণ করেছে বটে। কিন্তু এসবের বাস্তবিক ফল অনুসন্ধান করা কঠিন কিছু নয়।

লেখক : সাংবাদিক।

Link copied!