এ সময়ে জনপ্রিয়তা লাভের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে নতুন কারিকুলামের নামে নেতিবাচকতা ও গুজব ছড়ানো। এই নেতিবাচকতা ছড়াতে গিয়ে একেকজন একেক রকমভাবে কথা বার্তা বলে বেড়াচ্ছেন। উদাহরণ দিয়ে বলি বরং। যেমন ধরেন, কোচিং ব্যবসা, এটা তো বাংলাদেশে নতুন নয়। ব্যবসার জন্য শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান না, খাতায় ইচ্ছে করে কম নম্বর দেন, ফেইল করিয়ে দেন—এসব অভিযোগ কিন্তু নতুন নয়। অভিভাবকেরা যুগ যুগ ধরেই এ অভিযোগগুলো করে আসছেন এবং এগুলো অনেক ক্ষেত্রে সত্য। নইলে শিক্ষকদের দেদারসে কোচিং ব্যবসা কমানোর জন্য সরকার আইন প্রণয়ন করতো না। যদিও এসব আইন কতখানি মানা হচ্ছে, সেসব অন্য হিসেব। বলছিলাম, কোচিং ব্যবসা নিয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা। এখন নতুন কারিকুলামের বদনাম করার জন্য সেই একই কুমিরের বাচ্চা সাত বার দেখানোর মতো করে, কোচিং ব্যবসার কথাই বলা হচ্ছে! বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভার শিক্ষকদের ওপর পুরোপুরি রাখা উচিত নয়, কারণ শিক্ষকেরা অসৎ তারা কোচিং ব্যবসা করে ফায়দা লুটতে চান। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, পুরোনো কারিকুলামের যুগে প্রশ্ন করা, খাতা দেখার কাজগুলো কারা করতেন? তখন কেন অভিভাবকদের মনে এমন সন্দেহবাতিকতা তৈরি হয়নি?
বরং নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের দলগত উপস্থাপনা হয় সবার সামনে। উপস্থাপনা শেষে শিক্ষার্থীরাই পরস্পর সম্পর্কে ফিডব্যাক প্রদান করে। তাহলে এখানে একজন শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা বা পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ তো থাকছেই না। আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার জন্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একাধিক মূল্যায়নকারী রাখার নিয়ম করা যেতে পারে। এছাড়াও আচরণিক সূচক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও শিক্ষকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। সবার মতামতের ভিত্তিতেও জানা যাবে একজন শিক্ষার্থী তার কাজে সৎ, দায়িত্বশীল ও সক্রিয় কি না। তাহলে কেন শুধু শুধু শিক্ষকদের দিকে অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দিয়ে মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে? তাতেও যদি সন্দেহ থাকে, তবে অভিভাবকদের দিয়েও কিছু অংশ মূল্যায়ন করানো হোক। কিন্তু একজন অভিভাবক কি পারবেন সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজ সন্তানের মূল্যায়ন করতে? যেখানে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ/অ্যাসাইনমেন্ট/পোস্টার অভিভাবকে নিজেরাই সব করে দিচ্ছেন। অভিভাবকদের ওপরেই বা মূল্যায়নের জন্য কীভাবে আস্থা রাখা যাবে?
নতুন কারিকুলামের এক শ্রেণির বিরোধিতাকারী কোচিং ব্যবসার দৌরাত্ম বেড়ে যাবার অভিযোগ করছেন। মজার ব্যাপার, আরেক শ্রেণির বিরোধিতাকারী আবার পুরো ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে কোচিং ব্যবসায়ীদেরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়ছেন। প্রশংসা করতে করতে তারা কোচিংয়ের শিক্ষকদের স্কুল কলেজের শিক্ষকদের চেয়েও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে নেতিবাচকতা ছড়ানো। স্কুলে কোনো পড়ালেখা হয় না, স্কুলের শিক্ষকেরা কিছুই জানেন না, স্কুলের পরিবেশ ভালো না, এই জাতীয় নেতিবাচকতা যতই ছড়ানো হবে, ততই অভিভাবকেরা কোচিং সেন্টারমুখী হয়ে উঠবেন। অথচ, কবুতরের খোপের মতো কোচিং সেন্টারগুলোতে পড়ায় নিতান্তই সাধারণ কিছু শিক্ষার্থী, যাদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, কোনো অভিজ্ঞতা। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিই ভালো পড়ায়। কিন্তু একটা স্কুল যা দিতে পারে, কোচিং সেন্টার কি তা পারে বা পারবে কোনদিন? একটা স্কুলে খেলার মাঠ থাকে, ল্যাবরোটারি থাকে, পাঠাগার থাকে, থাকে বিতর্ক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্লাব। একটা স্কুলে প্রতিদিন প্রাতসমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা ও শপথের মাধ্যমে দিন শুরু হয়। স্কুলে শিক্ষার্থীরা শুধু পড়তেই আসে না, বন্ধুদের একত্রে পড়ালেখা ও খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের মধ্যে নানা রকম সফট স্কিল (সামাজিকতা, নেতৃত্বদানের গুণ, পরমতসহিষ্ণুতা, শেয়ারিং, কেয়ারিং, নিজের মতামত প্রদান,সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতা, সময়ানুবর্তিতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা ইত্যাদি ) বিকশিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একটা কোচিং সেন্টারের উদ্দেশ্য শুধু এ প্লাস পাইয়ে দেওয়া। অভিভাবকেরা এত বেশি কোচিং সেন্টারমুখী আর এগুলো এতই দৌরাত্ম যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিকতা শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। রাস্তায় একজন মানুষকে সাহায্য করার চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ প্লাস পাওয়া। আর ওদিকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলার মাটির সাথে সংযোগবিহীনভাবে ’না বাংগালি না ইংরেজ’ ধরনের শংকর জাতির হিসেবে বেড়ে ওঠতে থাকে। তারপরেও এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল অভিভাবকদের পকেট কেটে নিজেরা লাভবান হবার জন্য নতুন কারিকুলামের নামে এমন ভাবে নেতিবাচকতা ও আতংক ছড়াচ্ছেন, যেন সবাই কোচিং সেন্টার ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলমুখী হয়ে ওঠে। সরকারকেও এমনভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে, কে জানে হয়তো পরবর্তী বাজেটে বাংলা মাধ্যমের স্কুল নয়, কোচিং সেন্টার আর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।
লেখক : শিক্ষক








































