• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

হেনরি কিসিঞ্জার : শরণার্থী থেকে ইতিহাসের খলনায়ক


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: নভেম্বর ৩০, ২০২৩, ০৬:০৫ পিএম
হেনরি কিসিঞ্জার : শরণার্থী থেকে ইতিহাসের খলনায়ক
গত শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন হেনরি কিসিঞ্জার

হেনরি কিসিঞ্জারকে (হেঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার) ইতিহাস দুইভাবে চিনলেও তাকে বেশি চেনা হয়েছে খলনায়ক হিসেবে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসও জড়িত। তবে তাকে তার কৃতকর্মের জন্য বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। অনেকে এখন তার ‘নিপীড়নমূলক ও প্রাণঘাতী কৃতকর্ম’ নিয়ে মুখ খুলছেন। তবে দশকের পর দশক ধরে রাজনীতি ও গণমাধ্যমে দক্ষ কূটনীতিক হিসেবে উচ্চকিত প্রশংসার ভেতরে চলতি বছরের ২৭ মে নিজের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করলেন তিনি। যিনি গত শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন।

জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা এক ইহুদি শরণার্থী কিশোর বিশ্বের বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। দুই প্রেসিডেন্ট—রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে কাজ করা কিসিঞ্জার এক অর্থে মার্কিন শাসকদের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়েই ওঠেন।

একদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানে প্যারিস শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন। অন্যদিকে কম্বোডিয়ায় বোমা ফেলা, চিলিতে নির্বাচিত সরকারের পতনে তার ভূমিকা গোপন থাকেনি।

দুই। 

আমাদের চোখে তিনি ধিক্কারের পাত্র। আর মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক নিকোলাস টমসনের মতে তিনি ইতিহাসের জঘন্যতম একজন মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে খোলাখুলি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। গোপনে চীন সফর করে সেই দেশকে বাংলাদেশের বিরোধিতায় উৎসাহিত করেন। যদিও একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই ঘিরে মুক্তিযুদ্ধে চীন সরাসরি জড়ায়নি। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনাকে সাহায্য করতে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন। 

মার্কিন কূটনীতিক-কংগ্রেসম্যান ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেনের মতে, “নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি যদি একাত্তরের ঘটনাবলিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে না দেখে সংকটের আঞ্চলিক (অর্থাৎ দক্ষিণ এশীয়) পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতেন, তাহলেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ সবচেয়ে জোরালোভাবে রক্ষিত হতো। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল পাকিস্তানি সামরিক হামলার নিন্দা করা এবং মার্কিন সামরিক নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যদি ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় প্রশ্নে মার্কিন কংগ্রেস ও জনগণের উদ্বেগ ব্যাখ্যা করে বোঝানো হতো, তাহলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ স্থাপনের দূত হিসেবে যে কাজ তিনি করছিলেন, তাতে বিঘ্ন ঘটত না। কারণ, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই নিজেদের স্বার্থে এই উদ্যোগকে অক্ষুণ্ন রাখতে আগ্রহী ছিল। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ওপরেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ছিল সীমিত, কিন্তু গোড়া থেকেই যদি তিনি (গণহত্যার বিরুদ্ধে) একটি নীতিগত অবস্থান নিত, তাহলে এই দুই দেশের নেতৃত্বের কাছেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেত।”

পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র পাঠানোর যে ষড়যন্ত্র নিক্সন-কিসিঞ্জার করেন, তা থেকেই স্পষ্ট, দেশটির সামরিক নেতৃত্বকে আগলে রাখার দায়িত্ব তারা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের আগে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র পাঠায়, যা বাঙালিদের লড়াই দমনে ব্যবহৃত হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মার্কিন গবেষক অধ্যাপক স্টেফান শালোমের হিসাবে, ২৫ মার্চের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্রবাহী ১০টি জাহাজ পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করে। এসব জাহাজে যে অস্ত্র পাঠানো হয়, তার মূল্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার। শালোমের তথ্য অনুসারে, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের পর একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানো অব্যাহত রাখে (জেট ম্যাগাজিন, সেপ্টেম্বর ১৯৯১)।

তিন।

বাংলাদেশকে নতুন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং পাকিস্তানকে গণহত্যা থেকে বিরত করার দাবি নিয়ে বিশ্বের নানা দেশের পাশাপাশি সে সময় একাধিকবার আমেরিকা সফরে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একাধিক চিঠিও লেখেন তিনি। ১৯৭১-এর জুলাইয়ে ভারত সফরে আসা কিসিঞ্জারকে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান এত বাড়াবাড়ি করার সাহস পাচ্ছে স্রেফ আপনাদের সমর্থনের জোরে।’ 

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতাই শুধু নয়, দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকেও নানাভাবে খাটো করার চেষ্টা করেন কিসিঞ্জার। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে নিজের নৈতিক পরাজয়ের শোধ নিয়েছিলেন কিসিঞ্জার সদ্য স্বাধীন দেশটিকে ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়ে। বাংলাদেশের আর্থিক প্রগতি নিয়ে আলোচনায় বারবার এ প্রসঙ্গটি উঠে আসে। ১৯৭৪ সালে পিএল ৪৮০–এর গম সরবরাহ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষে আরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।

তবে হেনরি কিসিঞ্জারের এসব অপকর্ম শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার প্রচ্ছন্ন আস্কারায় ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিআইয়ের সহায়তায় সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল অগাস্তো পিনোশে। ১৯৭৬ সালে তার ‘সবুজ সংকেত’ পেয়ে আর্জেন্টিনায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইসাবেল পেরনকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী এবং দশকব্যাপী ‘ডার্টি ওয়ার’–এর সূচনা করে। কঙ্গোর একনায়ক মবুতু সেসে সেকোকে প্রশংসা ও সমর্থন দিয়ে গেছেন কিসিঞ্জার। তালিকাটি আরও দীর্ঘ।।

চার। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যায় কিসিঞ্জার নানাভাবে তার ভূমিকার সাফাই গেয়েছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ আটলান্টিক পত্রিকায় ২০১৬ সালে জেফ্রি গোল্ডবার্গের সঙ্গে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মূল্য হিসেবে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ মেনে নেওয়া যায় কি না—এমন এক প্রশ্নের জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, “মানবাধিকার ও জাতীয় নিরাপত্তা—উভয় নীতি দ্বারাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত। সব সময় এই দুইয়ের মধ্যে একটা বেছে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু কখনো কখনো জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হয়, ১৯৭১ সালে যেমন হয়েছিল।”

বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কিসিঞ্জার বলেন, “বাঙালিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমনে ইয়াহিয়া চূড়ান্ত সহিংসতা প্রদর্শন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন।” তিনি এও বলেন, ‘কিন্তু (সে সময়) এই সহিংসতার নিন্দা করার অর্থ দাঁড়াত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনার সমাপ্তি।’ কিসিঞ্জারের ভাষ্যে, একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র যা করে, তা সবই ছিল সে স্বার্থ সমুন্নত রাখার চেষ্টা। 

এই সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জার এমন দাবি করেছেন, তাদের অনুসৃত নীতির সাফল্যের কারণেই ১৯৭২ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় (প্রকৃতপক্ষে মার্চে নয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়)। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিক্সন বেইজিং সফর করেন এবং মে মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আণবিক অস্ত্র চুক্তি (সল্ট) সম্পাদন সম্ভব হয়।

পাঁচ।

সুইস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জাসি এম হানহিমাকির কিসিঞ্জার-নিক্সন অনুসৃত নীতির ফলে বাংলাদেশ সংকট এবং সেখানে গণহত্যা কেবল দীর্ঘায়িতই হয়েছে। একাত্তরে যে অসংখ্য মানুষের জীবনহানি হয়, এর সবকিছুর জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই ট্র্যাজেডি ঠেকাতে সে আরও অনেক বেশি কিছু করতে পারত, বিশেষত কিসিঞ্জার নিজেই যেখানে বলেছেন, বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। ( ফ্লড হেনরি কিসিঞ্জার অ্যান্ড আমেরিকান ফরেন পলিসি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪)।

২০০১ সালে মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচিন্স তার ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করেন। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতি হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সমর্থনের সপক্ষে একাত্তরের ৬ মার্চে প্রস্তুত দলিলটিকে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওই মার্কিন দলিলই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক অভিযানকে নিরুৎসাহিত করাকে তিনি মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মনে করেননি। অথচ বাংলাদেশ-সংকটে ভারতের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপকে নিবৃত্ত করার বিষয়ে তিনি এদিনই পাকা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি বলেছিলেন, ‘আমাকে শয়তানের পক্ষে ওকালতি (ডেভিলস অ্যাডভোকেট) করতে দাও।

জেনারেল ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য ‘রক্তস্নান’ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে তিনি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরামর্শ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা কেবল প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত থাকেননি। কিসিঞ্জার এ বৈঠকে উল্টো প্রশ্ন তুলেছিলেন যে ইয়াহিয়া রক্তস্নান নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন তার বিরোধিতা করতে হবে? কিসিঞ্জার এ প্রসঙ্গে অকপটে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দোহাই দিয়েছিলেন।

একাত্তরের ৬ মার্চ সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভায় তিনবার রক্তস্নান ও একবার রক্তপাত কথাটি উচ্চারিত হয়। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মার্কিনরা কী করবে, তা ঠিক করতেই ওই বৈঠক বসেছিল।

লেখক : সংবাদকর্মী

Link copied!