• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিদেলের স্বপ্নভূমি কিউবার স্বাস্থ্য আর খাদ্যনীতি


আরিফ রহমান
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৩, ০৯:০৬ এএম
ফিদেলের স্বপ্নভূমি কিউবার স্বাস্থ্য আর খাদ্যনীতি

ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সবাই ফিদেলের বিপ্লবী রাজনীতি নিয়ে কথা বললেও আমি আজ বলতে চাই তার গৃহীত কিছু নীতি কীভাবে এই পুঁজিবাদী পৃথিবীর নাকের ডগায় কিউবাকে অদ্ভুত এক রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছে, সেটা নিয়ে। কিউবায় তিনি যা কিছু করেছেন সবটা একবারে বলা যায় না। তবুও জেনে নেওয়া ভালো কিউবায় তিনটা জিনিস অলমোস্ট ফ্রি—খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা। আজ আমরা আলাপ করবো কিউবার স্বাস্থ্যখাত আর খাদ্য নিয়ে।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকেই, অর্থাৎ ফিদেল ক্ষমতা দখলের পর থেকেই স্বাস্থ্যখাতকে নম্বর ওয়ান প্রায়োরিটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৬ সালে যখন কিউবার সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন সংবিধানের ৫০ নম্বর অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সংবিধানের মাধ্যমেই এই অধিকারটি নাগরিকের জন্য প্রতিষ্ঠিত।

মূলত কিউবার মেডিকেল সিস্টেমে সবার জন্য সব ধরণের চিকিৎসা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। কিউবা একটা ফিলোসফিতে বিশ্বাস করে, রোগ নিরাময়ের চাইতে রোগ প্রতিরোধ করা বেশি জরুরি। এবং এজন্যই কিউবায় প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য ৭৪ জন চিকিৎসক এবং ১০ জন ডেন্টিস্ট নিয়োগ দেওয়া আছে। অর্থাৎ এই দেশের নাগরিকদের শতকরা ৮ দশমিক ৪ শতাংশই চিকিৎসক।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকে কিউবা প্রচুর পরিমাণ চিকিৎসক তৈরি করতে প্রচুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। ডব্লিউএইচওর মতে সারা পৃথিবীর চিকিৎসকদের উৎকর্ষের বিবেচনায় কিউবা অন্যতম শীর্ষ উৎকর্ষের চিকিৎসা শিক্ষা দিয়ে থাকে।

শুধু তাই না, কিউবার নবজাতকের মৃত্যুহারের ইনডেক্সে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এটা প্রতি হাজারে ৪ দশমিক ২, যেটা আমেরিকা এবং ব্রিটেনের চেয়েও কম, বাংলাদেশে এই হার এখন হাজারে প্রায় ১৫। কিউবার গড় আয়ু এখন ৭৮ বছর, যেটা পার্শ্ববর্তী আমেরিকার সমান।

সারা পৃথিবী জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সেনাবাহিনী পাঠায় আর কিউবা পাঠায় চিকিৎসক। তাদের যুদ্ধ শান্তির। পৃথিবীর ১০৭টা দেশের মানুষের শান্তির জন্য, অসহায় মানুষের চিকিৎসার জন্য, মানুষে দুঃখ লাঘব করার জন্য ৩ লাখ কিউবান চিকিৎসক কাজ করছেন।

কিউবা স্বাধীন হওয়ার পর পৃথিবীতে এমন কোনো দুর্যোগ নেই যেখানে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিউবান চিকিৎসকরা যাননি। করোনা, সুনামি, ভূমিকম্প এমনকি কিউবাকে ধ্বংস করতে চায় যে আমেরিকা, সেখানে যখন ক্যাটরিনা আঘাত হানে তখন কিউবা ১৫০০ চিকিৎসক দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলো। যদিও আমেরিকা সেটা প্রত্যাখ্যান করে।

এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার, খুব কাছের একটি দেশ হওয়ার পরেও কিউবাকে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়ে কিংবা জরুরি মেডিকেল ইকুপমেন্ট ক্রয়ের বিষয়ে আমেরিকা কখনো সাহায্য করেনি গত পঞ্চাশ বছরে।

২০০৫ সালে ভেনিজুয়েলার সঙ্গে কিউবার একটি অদ্ভুত চুক্তি হয়, সেই চুক্তির নাম অপারেশন মিরাকেল। এই চুক্তির আওতায় কিউবার প্রায় ২০ হাজার চিকিৎসক ভেনিজুয়েলাতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে যান এবং বিনিময়ে ভেনিজুয়েলা থেকে পায় জ্বালানি তেল। সারা পৃথিবীর ৩৭ লাখ মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন কিউবার চিকিৎসকরা।

প্রতি বছর সারা পৃথিবী থেকে ২৫ হাজার মানুষ কিউবায় যান শুধু চিকিৎসার জন্য। আমেরিকার কারণে প্রায় পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এই দেশটা অত্যন্ত গরীব হলেও সস্তা চিকিৎসা আর আতিথেয়তায় তাদের জুড়ি নেই। কিউবার জিডিপিতে এই মেডিকেল টুরিস্ট আর ওষুধ রপ্তানি বেশ বড় ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা থেকে প্রাপ্ত আয় তো আছেই।

কিউবার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয় পপুলেশন হিসেব করে। প্রত্যেক চিকিৎসককে বছরে দুইবার করে নাগরিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়, যদি তারা সুস্থ থাকেন তবুও। অর্থাৎ কিউবার নাগরিক হলে আপনি সুস্থ থাকলে বছরে দুইবার চিকিৎসক বাসায় এসে আপনার মেডিকেল হিস্ট্রি রেকর্ড নিয়ে যাবেন। আর অসুস্থ হলে তো কথাই নেই। বাসার আশেপাশে কোনো ময়লা আবর্জনা আছে কি-না, সেই আবর্জনা থেকে কোনো রোগের সংক্রমণের সুযোগ আছে কি-না সেটার খবর রাখতে হয় চিকিৎসককে।

এবার আসুন একটু জেনে নেই কিউবায় ‘খাদ্য’ বিষয়টিকে কীভাবে নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অল্প কিছুদিন পর থেকেই কিউবায় রেশনিং সিস্টেম শুরু করা হয় (১৯৬২ সাল থেকে)। প্রত্যেক কিউবান পরিবারকে একটি লোকাল সাপ্লাই স্টোরে নিবন্ধন করে নিতে হয়, সংসারের প্রতি সদস্যকে দেওয়া হয় একটি করে রেশনিং বই।

২০১৬ সালে প্রতিটি নাগরিকের এক মাসের রেশন

১. ১০ কেজি চাল
২. ৬ কেজি সাদা চিনি
৩. ২ কেজি লাল চিনি
৪. ২৫০ মিলি রান্নার তেল
৫. ১২ টি ডিম
৬. ১ প্যাকেট কফি
৭. ৬ কেজি মাংস
৮. প্রতিদিন একটি করে বড় রুটি
৯. প্রতি তিন মাসে এক ব্যাগ লবণ

এর বাইরে গর্ভবতী নারী এবং ৭ বছর বয়সের নিচের শিশুদের জন্য থাকে প্রতিদিন এক বোতল দুধ। অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য বরাদ্দ করা হয়।

এটা দেশের প্রতিটি নাগরিককে প্রদান করা হয়। ধনী-গরীব, বড়লোক-ছোটলোক, নেতা-চামচা সবাইকে। এর বাইরে আমাদের মত নরমাল বাজারঘাট তো আছেই। যে যার মত জিনিষপত্র কিনছেন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী।

তবে এই রেশন সবার জন্য। গোটা মাসের রেশনের জন্য নাগরিককে কত টাকা দিতে হয় জানেন? বিশ্বাস করতে পারবেন না শুনলে—মাসে সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ ষোল ডলারের কিছু কম! অর্থাৎ যদি আপনি কিউবার নাগরিক হন তাহলে প্রতি মাসে খেয়ে-পরে থাকার জন্য আপনাকে কিউবায় খরচ করতে হয় মাত্র এই কয়টা টাকা। হ্যাঁ এটা এক মাসের খরচ।

কিউবায় মানুষ না খেয়ে মারা যায় না বিপ্লবের পর থেকে। কিউবার মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যায় না বিপ্লবের পর থেকে।

ফিদেলকে জানতে হলে আমি তাই তার বিপ্লবী জীবনকে দেখি না। দেখি কিউবাকে। একজন মানুষ হিসেবে ফিদেলের আর কি কিছু পাওয়ার বাকি আছে?

আমাদের দেশটা স্বাধীনতা হওয়ার সময়েও এমনই একটা স্বপ্ন ছিলো, আমাদের দেশের সংবিধানেরও এমনসব কথাই লেখা ছিলো (এখনো আছে)। এরপর আমাদের একদল রাজনীতিবিদ সমাজতন্ত্রকে হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত করে ছাড়লেন। প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সমাজবাদীদের চিহ্নিত করা হল শত্রু হিসেবে। অথচ আজকের এই সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য চিকিৎসা, পাঁচটি মৌলিক অধিকারের ধারণা সমাজতন্ত্র থেকে ধার করা।

ফিদেলের প্রয়াণ দিবসে পৃথিবীর মেহনতি মানুষ আরেকজন ফিদেল ক্যাস্ট্রোর প্রত্যাশায় স্বপ্ন দেখে। কে জানে হয়তো সত্যিই একদিন বাংলাদেশে মানুষও সারা মাসের রেশন কাঁধে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরবেন। রাস্তার ধারে কেউ ঘুমোবেন না, টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় আর কেউ মারা যাবেন না।

Link copied!