• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

আফগান-নারীদের ডিভোর্স এবং স্বামীর ঘর


জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৩, ০৮:৩৬ এএম
আফগান-নারীদের ডিভোর্স এবং স্বামীর ঘর

নারী নির্যাতনের চিত্র দেশ-কাল-স্থান-পাত্রভেদে সবক্ষেত্রেই রয়েছে। তবে নির্যাতনের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। কিন্তু ইদানিং বারংবার সামনে উঠে আসছে আফগানিস্তানের নারীদের করুণতম নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনা। এর আগেও যে আফগান নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়নি, তা নয়। তবে তালেবান সরকার আসার পর থেকে নারীদের ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

বর্তমানে আফগান নারীদের জীবনযাপনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দেশটি। এর ফলে সে দেশের নারীরা স্কুল- কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এমনকি নারীদের পার্কে বেড়ানোর ক্ষেত্রেও এসেছে নিষেধাজ্ঞা। তালেবান সরকারের কট্টরপন্থী মনোভাবের ফলে এ দেশের নারীরা বিভিন্ন দিক থেকে বাধার মুখে পড়ছে। তালেবান সরকার শুধু যে পড়াশোনা,  জীবনযাপনের ওপর রেশ টেনেছে এমন নয়; বরং দাম্পত্য সম্পর্কেও তারা চাপ প্রয়োগ করতে দ্বিধা করছে না। এর ফলে নারীরা উপায় না দেখে আত্মগোপন করতেও বাধ্য হচ্ছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এমনও অনেক আফগান নারীর দেখা মিলেছে, যারা স্বামীর নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তালেবান সরকার এই নারীদের পুনরায় সেই নির্যাতনকারী স্বামীর কাছেই পাঠাচ্ছে। যা মানবিকতার চরম অবমাননা। এই নারীরা বলছেন, দাম্পত্য জীবনে স্বামীর নির্যাতন নিত্য ঘটনা ছিল। বছরের পর বছর এভাবে অসহনীয় নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিতে বাধ্য হন। তবে তখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকার। কিন্তু ২০২১ সালে সেই সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তালেবান। আর এরই মাধ্যমে তারা আগের সরকারের সময়ের বিবাহবিচ্ছেদ আদেশ বাতিল করে স্ত্রীদের তাদের সাবেক স্বামীর কাছে ফেরত যেতে বাধ্য করছে। তবে এসব নারী স্বামীর কাছে ফেরত গেলেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং জীবনে নেমে এসেছে আরও দুর্বিষহ কষ্ট।

তালেবানদের এমন নির্মম অত্যচারের ফলে অনেক নারী আত্মগোপনে যেতেও বাধ্য হচ্ছেন। দেশটিতে নারীরা শোষণের ভয়াবহ রূপের শিকার। তাদের নিজস্ব মত-পথ-স্বাধীন জীবনযাপন কোনোটাই নেই। একটি দেশের জনগণ যখন সে দেশেরই শাসক দ্বারা অত্যাচরিত-নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়, তখন বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ জরুরি। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথের মতো বড় কূটনৈতিক- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নতুবা এদেশের নারী জাতি শোষকের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে আরও। একপর্যায়ে তাদের সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখা দেবে। যার ফলে বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। তাই তালেবানদের নৈরাজ্য দূর করতে হলে বিশ্বের বড় বড় অঙ্গসংগঠনের এগিয়ে আসতে হবে। শোষকের নিপীড়ন থেকে নারীদের রক্ষা করতে হবে।

আফগান নারীরা যেভাবে শৃঙ্খলে বন্দি তা মানবিক বিপর্যয়। মানবতার চরমতম লঙ্ঘন। তালেবান সরকারের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে সে দেশের নারীদের জীবনে যেমন বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে বহির্বিশ্বেও এর আঁচ লাগতে পারে। তালেবান সরকারের কট্টর সিদ্ধান্তের বলি নারীরা! তবে আধুনিক যুগে এসেও মানুষ যখন নিজের দেশেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি হয় তখন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি। এ লক্ষে বিশ্ববাসীকে একজোট হয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই সংকট মানবসৃষ্ট ফলে সহজেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যদি পরিপূর্ণ এবং সঠিক উদ্যোগ গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়।

বিগত ২ বছরে তালেবান সরকারের অপমানিক অত্যাচারের শিকারে বদলে গেছে নারীদের সুন্দর জীবন। নারীরা এখন ঘরবন্দি মানবেতর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তবে নারীরা এই ঘরবন্দি জীবনে আপত্তি জানালেও দেশটির সরকারের কট্টর নীতির কাছে সবাই স্তব্ধ। 

একটি দেশের কর্ণধার সে দেশের আপামর জনগণ। সে নারী-পুরুষ উভয়ই। তবে নারীর পথকে যখন থমকে দেওয়া হচ্ছে তখন সে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে বাধ্য। তবে এই নারীদের শিক্ষা, চাকরির সুযোগ বঞ্চিত করে তাদের ওপর আরও কঠোর নীতি প্রণয়ন করছে দেশটির সরকার। দাম্পত্য সংকট এবং এর জেরে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলেও সেই নারীদের ফেরানো হচ্ছে তারই পূর্বের নিপীড়ক স্বামীর কাছে। যেখানে স্বস্তির চেয়ে মানসিক-শারীরিক পীড়ন বেশি। এই নারীদের ওপর বল প্রয়োগ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া অনৈতিক। তবে যা অনৈতিক তাকেই তালেবানরা নৈতিকতার ছাপ দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে। তবে সুশীল সমাজের অধিকারী মানুষ মাত্রই জানেন এবং বোঝেন এসব কর্মকাণ্ড নীতিবিরুদ্ধ।

রক্ষকই যখন ভক্ষক তখন জনগণের জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তা স্বাভাবিক। তবে জনগণ চাইলে বিদ্রোহ করতেই পারে। সে লক্ষে দেশের জনসাধারণকে এক হতে হবে। কিন্তু আফগানিস্তানের পুরুষতান্ত্রিক এবং কট্টরপন্থী মনোভাবের শিকারে পড়েছে নারীরা। ফলে জলে-ডাঙায় উভয় জায়গায়ই তাদের জীবন অতিষ্ঠ। ঘরে যে পুরুষের সান্নিধ্যে নিজেদের দুঃখকে ভুলতে চেষ্টা করবে, সেই পুরুষও তো ওই সমাজেরই। ফলে কোথায় যাবে এই নারীরা। তালেবানদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মৃত্যুই সেখানে অনিবার্য হয়ে উঠবে। কঠিন সংকটে দেশটির নারীরা। আবার  বিচ্ছেদ কাটিয়ে উঠে নতুনভাবেও এই নারীরা জীবন শুরু করতে পারছেন না।

আফগনিস্তানের নারীদের সহোযোগিতায় বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি যেকোনো দেশ যখন শাসন-শোষণে ব্যস্ত হয় তখন সেই কর্মকাণ্ড যেন বহির্বিশ্বে প্রকাশিত না হয় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। তারপরও যদি দেশের বাইরে নারীদের এমন হীন পরিস্থিতির কথা উল্লিখিত হয়, তবে দেশটির অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি আরও কতটা কদর্য-ভয়াবহ হতে পারে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এখনই সময় বিশ্বের ক্ষমতাধারী দেশগুলোর জোট বেঁধে দেশটির সরকার-প্রশাসনের ওপর বল প্রয়োগ করা। যেন কিঞ্চিৎ হলেও নারীদের জীবনের পরিবর্তন ঘটে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।

Link copied!