কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ হত্যা : নতুন করে ভাবতে হবে বিশ্বকে


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩১, ২০২৩, ০৩:২০ পিএম
কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ হত্যা : নতুন করে ভাবতে হবে বিশ্বকে

মনে আছে জর্জ ফ্লয়েডের কথা? পুলিশের অমানবিকতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম বড় আন্দোলনের সূচনা ঘটে। সেবার জনগণ এতটাই উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল যে ১৫ থেকে ২৬ মিলিয়ন মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, অন্তত নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট সে কথাই বলে। জর্জ ফ্লয়েড মৃত্যুবরণ করেছিলেন পুলিশি নির্যাতনে। ২০২১ সালে অবশ্য হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে একটি পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য একটি আইন পাসের প্রস্তাব হলেও তা সিনেটে কোনো কারণে আটকে যায়। ২০২২ সালেও জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে উপজীব্য করে আন্দোলন চালিয়ে যান মানুষ। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা এতটাই প্রবল ছিল যে রিপাবলিক নিয়ন্ত্রণাধীন প্রদেশগুলোতে সড়ক নিরাপত্তা আইন পাস হয়। কারণ, অনেকে সড়কে গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যুবরণ করেন।

এই আন্দোলন শুধু বর্ণবাদেরই নয়; বরং ক্ষমতার বিরুদ্ধেও। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি অনুসারে বর্ণবাদ এতটাই প্রবল যে আমাদের দেশে এ নিয়ে ভাবাটা দুষ্কর। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। তার আগে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার দিকে চোখ ফেরানো যাক। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের মেমফিস শহরের সড়কে অপরাধ দমনে পুলিশ ৫০ সদস্যের একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করেছিল। এর নাম ‘স্ট্রিট ক্রাইমস অপারেশন টু রিস্টোর পিস ইন আওয়ার নাইবারহুড’। স্করপিয়ন নামে এ ইউনিটটি সবার কাছে পরিচিত। ২০২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নিকোলাস টায়ার নামে এক কৃষাঙ্গ তরুণকে হত্যার অভিযোগ আসে এই ইউনিটের বিরুদ্ধে। নিকোলাস টায়ার বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে তাকে আটকে নির্যাতন করা হয়। পরে নিকোলাস টায়ার মৃত্যুবরণ করলে আবারও জেগে উঠে বিশ্ব। নিকোলাস দোষী হলেও তার মৃত্যু মেনে নেওয়ার নয়। নিকোলাসের মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয় এবং ওই বিশেষ পুলিশ ইউনিট বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু তাতে তো নিকোলাস টায়ারের ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধের দায় থেকে কেউ নিষ্কৃতি পেতে পারেন না।

প্রথমেই জর্জ ফ্লয়েডের কথা কেন টেনে আনা হলো,  এবার সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। নিকোলাস টায়ারকে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য যেভাবে প্রহার করা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। সে ফেডেক্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা। কোনো ভয়ংকর অপরাধী নন। আপাতত সে কথাও জানা যাচ্ছে না। তাকে প্রহারের একপর্যায়ে মা-কে উচ্চস্বরে ডেকে ওঠার দৃশ্যে কেঁপে ওঠার জন্য অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই জর্জ ফ্লয়েডের মতোই, আবারও পুলিশের হাতে নির্যাতনের শিকার। আমরা প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের প্রশংসা করি। কিন্তু সেখানেও পুলিশ সদস্যদের ভেতর অপসংস্কৃতি চর্চা আছে।

তাদের ভেতর থাকা জিঘাংসা তারা আইনের আদলে পুষিয়ে নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। এই আলোচনার মধ্যে সম্প্রতি বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের সময় একটি ছেলেকে গ্রেপ্তারের খবরের কথাও মনে পড়ে। ছেলেটি গিয়েছিল জার্সি কিনতে। বয়স ১৭। ভুলক্রমে ওই সংঘর্ষের জায়গায় ছিল। পুলিশ তাকে সন্দেহবশত গ্রেপ্তার করে। সে না হয় হলো। কিন্তু তাকে ১৯ বছর বয়সী দেখিয়ে মামলা করে দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এখানেও যে পুলিশ সদস্যদের ঘৃণার চিত্র দৃশ্যমান তা অস্বীকার করা যাবে না।

এ ঘটনার পর আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংযুক্ত করে এখনো কেউ ভেবে দেখতে পারছেন না হয়তো। অনেকেই মানবতা ও বর্ণবাদী ভাবনার প্রতি নিন্দা জানাচ্ছেন। কিন্তু মূল জায়গাটি যে সাংস্কৃতিক, তা হয়তো অনেকেই দেখতে পারছেন না। কোনো রাষ্ট্রে কৃষাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ ঘৃণা এবং অন্য কোথাও তা ধনী-দরিদ্র বা তার বেশভূষা দেখে সন্দেহের ভিত্তিতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই যখন এমন অনিরপেক্ষ থাকে, তখন ন্যায়বিচারের আশা করা কঠিন। বিষয়টিকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে ভাবার অবকাশ নিলে সমস্যা আছে তা মানি। ব্যক্তির দায় তো আর সার্বিক পরিস্থিতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তবে এ কথা তো মানতে হবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে সহিংসতাও অনেকটা কমিয়ে আনা যায়।

মানবসৃষ্ট ব্যবস্থায় কখনোই শুদ্ধতা আশা করা যায় না। তাই মানুষ যখনই কোনো কিছু নির্মাণ করে তখন হিসাব-নিকাশ করে এগোন। গড়ে তোলেন একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার ভুল থাকলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে সমস্যা হওয়ার কথা না। এটিই গণতান্ত্রিক মনোভাব। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে ঘৃণা বা ব্যক্তিভাবনার অপপ্রয়োগের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক সিটবেল্ট বাঁধেননি বলে তার নামে মামলা হয়েছে। এক সামান্য কনস্টেবল এমন একটি কাজ করতে পেরেছেন এই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত আছে বলে। তবে ব্রিটেনেও যে অপরাধ হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিটি সংস্থাই তাদের কর্তব্যে পেশাদারত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। এ জন্যই তো বিষয়গুলো আমাদের কাছে সুন্দর হয়ে ধরা দেয়। আমরা বলি, ওদের আইন কত সুন্দর। এগুলোও কিন্তু মানুষেরই সম্মিলিত প্রয়াসে গড়া।

প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি এখন কীভাবে দেখা উচিত? এখানে মূলত ক্ষমতাসীন প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রকে নিজ নিজ অবস্থান বুঝতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি বলা হোক কিংবা রাষ্ট্রকাঠামো, জনগণের দাবি ও প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেবে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাই ঘটেছে। তারপরও বর্ণবাদ ঠেকানো যায়নি এবং সাম্প্রতিক ঘটনা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ সমস্যাকে আবার সামনে তুলে এনেছে। যখন কোনো সংস্কৃতিতে ঘৃণার রাজত্ব তখন রাষ্ট্রকাঠামোকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা শব্দটি ব্যাপক ব্যবহৃত। ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক মানুষকে তার সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়।

কর ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী কাঠামো সব সময় দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া জনতাকে নির্যাতন শিকার করতে বাধ্য করে। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা যখন সম্মিলিতভাবে এক জটিল আবহ তৈরি করে, তখন তা কাঠামোকেও প্রভাবিত করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে অবচেতনে এই ঘৃণার ব্যবহার করে বসে। অবশ্যই বিষয়টি ক্ষমতার অপব্যবহার। বৈশ্বিক সংকটে কাঠামোতে একদিকে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং অন্যদিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করার প্রভাব থেকেই অপরাধের সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশেও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিচারে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য অনেক সময় অন্যায় করছেন। তাই নিকোলাস টায়ারের বিষয়টিকে রাষ্ট্রকাঠামোর দায়ের ভিত্তিতে বিচারের প্রয়োজন সারা বিশ্বেই প্রয়োজন।

পরিশেষে, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় এই অপরাধের বিষয়টি কেমন প্রভাব ফেলছে, তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। আমরা এখনো তাকিয়ে থাকি পশ্চিমের দিকে। সেখানকার অনেক কিছু অবচেতনে আমাদের ভেতরও প্রবেশ করে। কিন্তু ঘৃণার থেকে দ্রুত আর কিছু বোধ হয় প্রবেশ করতে পারে না। এখন দেখার বিষয়, নিকোলাস টায়ারের হত্যার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কীভাবে সামলায়। শুধু একটি বিশেষ ইউনিট বিলুপ্ত করলেই এমন অপরাধ থামানো যাবে না। রাষ্ট্রের মানুষের সুষ্ঠু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য পর্যাপ্ত রসদ জোগানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশাল সমুদ্রকে আটকে না ফেলে একটি নির্ধারিত অংশে সীমানা বেঁধে যদি কিছু নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং সবাই এই সীমানার ভেতর ঠিক থাকে, তাহলে অন্তত কিছুটা শুদ্ধতার দিকে সব সিস্টেমই এগিয়ে যেতে পারবে।

লেখক : সংবাদকর্মী।

Link copied!