এক যুগের বেশি সময় ধরে সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ। দেশে মাঠে থাকা রাজনৈতিক দল এখন একটাই, সেটা আওয়ামী লীগ। একটাই রাজনৈতিক দলের মানে এই নয় যে দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই। দল আছে, তবে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে কেবল আওয়ামী লীগই। বাকিদের অস্তিত্ব আছে ঠিক, তবে দৃশ্যমান কর্মসূচি নেই। জাতীয় পর্যায়ে এই চিত্র যেমন বাস্তব তেমনি প্রান্তিক পর্যায়েও।
দেশে বর্তমানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনও সন্নিকটে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার কথা। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে সারাদেশে বিশেষত ইউপি পর্যায়ের প্রার্থী-সমর্থকদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। প্রার্থীরা নিজেদের মতো করে গ্রুপিং-লবিং করে চলেছেন, যার অনেকটাই বিভিন্ন গণমাধ্যমেও ওঠে এসেছে।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে এবারও। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকায় দলটির প্রতীক ‘নৌকা নিয়ে নির্বাচন করা মানেই জয়’ এমন একটা হাওয়াও বইছে। বাস্তবতাও তেমনই বলে। ‘নৌকার মাঝি’ হতে মরিয়া অনেকেই। স্থানীয়দের মনোনয়ন কেন্দ্রের কাছে যাচ্ছে, কেন্দ্র যাচাই-বাছাই শেষে মনোনয়ন চূড়ান্ত করছে। এর মধ্যে লবিংও চলছে সমানতালে। লবিং ও গ্রুপিংটা এমনই অবস্থায় যার কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এক মন্তব্যে। সম্প্রতি তিনি স্থানীয় নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন ‘টাকা খেয়ে কেউ যাতে কেন্দ্রে মনোনয়ন না পাঠায়’! ওবায়দুল কাদেরের এই হুঁশিয়ারি কেবলই যে দিকনির্দেশনা তা নয়, তিনি নিশ্চিত হয়েই নিশ্চয় বলছেন। নিশ্চয়ই তার কাছে এমন প্রমাণ আছে, যার কারণে টাকা খেয়ে কারও নাম না পাঠানোর কথা তাকে বলতে হয়েছে।
এক যুগের বেশি সময়ের শাসনের কারণে এখন দেশের সকলেই আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে, অন্তত দাবির ক্ষেত্রে। আদর্শিক বিষয় যে অনেক দূর সে প্রমাণ নানা সময়ে নানা ঘটনার সময়ে দৃশ্যমান হয়েছে। এত এত আওয়ামী লীগারের ভিড়ে প্রকৃত দল অন্তঃপ্রাণ ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না এমন অভিযোগও আছে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির অতি-পরিচিত শব্দ ‘অনুপ্রবেশকারী’ এখানেও স্মর্তব্য। এই অনুপ্রবেশকারীদের ভিড়ে ত্যাগীরা কোণঠাসা। এছাড়াও আছে নানা কারণে বিতর্কিত প্রার্থী, করোনাকালের ত্রাণ চুরি, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দে অনিয়মসহ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রার্থীও। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই নেতাদের দিক নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা জনপ্রিয় হলেও যেন তাদের মনোনয়ন দেওয়া না হয়।
কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দলের প্রার্থীদের নিয়ে যতই সাবধানবাণী উচ্চারণ করুন না কেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্র যাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করছে তাদের প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়ার কথা স্থানীয় পর্যায়ের কমিটিগুলোর। স্থানীয় পর্যায় থেকে যে নামগুলো কেন্দ্রের কাছে যাচ্ছে সেখানে কতখানি দলীয় আদর্শকে ধারণ করে এবং কতখানি কেন্দ্রের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে করা হচ্ছে তার পাশে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় হয়ে যায়। কারণ এখানে যেমন আছে প্রতি এলাকার স্থানীয় এমপিদের পছন্দ-অপছন্দের প্রার্থী, তেমনি আছে ওবায়দুল কাদেরের সন্দেহের জায়গা ‘টাকা খেয়ে প্রার্থীর সুপারিশ’। আওয়ামী লীগ কীভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করছে, কতখানি করতে পারছে?
প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা নিচ্ছে। করোনাকালের নানা ক্ষেত্রে অনিয়মের সঙ্গে যে সকল স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি জড়িত ছিলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দলীয় পরিচয়কে অগ্রাহ্য করে সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এটা ইতিবাচক দিক। এই জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই যে আবার আইনি পথে গিয়ে নিজেদের পুরনো হারানো আসন ফিরে পায়নি, তা কে বলবে? এবং এই ফিরে পাওয়াটা স্থানীয় পর্যায়ের সুপারিশকারীদের কাছে যদি তাদের যোগ্যতা হিসেবেও মূল্যায়িত হয়, তখন কী বলা হবে?
দায়িত্ব পালনে অনিয়ম, দুর্নীতির বাইরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইয়ের সবচেয়ে বড় ফিল্টার হতে পারে আদর্শিক, এবং সেটা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, হেফাজতের তাণ্ডবকে সামনে এনে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলাম এবং তাদের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক, মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী (প্রয়াত), মাওলানা ফয়জুল করিম চরমোনাই পীরের অনুসারীর সংখ্যা আওয়ামী লীগে অগণন। ধর্মীয় অপব্যাখ্যাকারী এই দুর্বৃত্তরা যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে ভেঙে-গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিল তখন স্থানীয় পর্যায়ের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থক ধর্মের নামে তাদের সমর্থন দিয়েছিল, কেউ কেউ প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও প্রতিবাদ করেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এত বড় অসম্মান সত্ত্বেও দেশের নানা প্রান্তের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কেউ কেউ নিজেদের এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন মাহফিলের নামে তাদেরকে সহযোগিতা করেছিল। এই শ্রেণির লোকজনের সংখ্যা সারাদেশে কম নয়। তাদের বেশির ভাগই ‘চান্সে আওয়ামী লীগ’, আদর্শিক দিক থেকে আওয়ামী লীগার নয়।
প্রার্থী চূড়ান্তকরণে আওয়ামী লীগকে ভাস্কর্য ও হেফাজত ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সারাদেশে এত এত আওয়ামী লীগার থাকলেও আওয়ামী লীগের আদর্শকে ধারণ করার মতো মানুষের সংখ্যা আগের মতোই। হেফাজতের তাণ্ডবের অংশীদার ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমর্থক কোনোভাবেই প্রকৃত আওয়ামী লীগার হতে পারে না। ভাস্কর্য ইস্যুতে সারাদেশের যে সকল জনপ্রতিনিধি হেফাজত-মামুনুলদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তারা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
কেন কেবলই আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নে আমাদের চোখ, প্রশ্ন হতে পারে। উত্তর খুব সহজ— নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা মানে এখন বিজয়ের পথে বড় এক পদক্ষেপ! এজন্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার তৃণমূল পর্যায়ে উগ্রবাদ ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠের লোকের দরকার। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এজন্যে দায়িত্বটা তাদেরই। তা না হলে তৃণমূলে ধর্মীয় অপব্যাখ্যাকারী সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি সরকারদল তৃণমূলের আদর্শিক শক্তিও হারাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































