• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

২০২২-এ হারালাম যাঁদের


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২২, ০৭:১০ পিএম
২০২২-এ হারালাম যাঁদের

এ বছর আমরা হারিয়েছি দেশবরেণ্য অনেককেই। তাঁরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্টজন। দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। ২২-এ হারানো এ বরেণ্যজনদের নিয়েই বছরান্তের এ প্রতিবেদন।  

কাজী রোজী

চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কবি ও রাজনীতিবিদ কাজী রোজী মারা যান। মৃত্যুর আগে টানা তিন সপ্তাহ করোনার সাথে যুদ্ধ করেন তিনি। কোভিড পজিটিভ হওয়ায় তাঁকে আইসোলেশন ইউনিটের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। সে সময় তার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না, কিডনিতে ইনফেকশন; মাল্টি অর্গান প্রবলেমও ছিল।

কাজী রোজী ২০০৭ সালে তথ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নেন। ষাটের দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন। তিনি জাতীয় সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনে প্রথমাবস্থায় নির্বাচিত অপর ৪৭ জন সদস্যের সঙ্গে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ‘সংসদ সদস্য’ পদে নির্বাচিত হন। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০২১ সালের বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক পান।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী

২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। 
শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। এর মধ্যে তিনি করোনায়ও আক্রান্ত হন। পরে তার অবস্থা সংকটাপন্ন হলে আইসিইউতেও নিলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।

‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার সেখানেই বসন্ত আমার’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’-এর মতো বহু কালজয়ী গানের রচয়িতা কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কাওসার আহমেদ চৌধুরী একজন জ্যোতিষী হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন।

সাহাবুদ্দীন আহমদ

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এ বছরের ১৯ মার্চ মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯২।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি এবং দুবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রথমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

২০২২ সালের ১৯ মে বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও জনপ্রিয় কলামিস্ট আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী মারা গেছেন। তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ডায়ালাইসিস কাজ করছিল না। এ সময়ন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।

১৯৫০ সালে ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে গাফ্‌ফার চৌধুরী অমর হয়ে আছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের জন্য। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০টি। ১৯৬৩ সালে ইউনেসকো পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ আরও অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী।

ফজলে রাব্বী মিয়া

জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়া চলতি বছরের ২২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি প্রায় ৯ মাস ধরে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন।
ফজলে রাব্বী মিয়ার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

ফজলে রাব্বী মিয়া গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের টানা সাতবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। এরপর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন। পরে ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দশম সংসদ থেকে তিনি ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কিংবদন্তি গীতিকবি, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার মারা যান। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, রচয়িতা, গীতিকার ও সুরকার। স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম নিয়ে তিনি অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখেছেন।

তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশের একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। ২০ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন তিনি। বিবিসি বাংলা তৈরিকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে তার লেখা তিনটি গান। তার লেখা কিছু কালজয়ী গান হলো ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’ প্রভৃতি।

আকবর আলি খান

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান এ বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়েছেন। পরে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ওপর পড়াশোনা করেন। তার পিএইচডি গবেষণাও অর্থনীতিতে।

সাজেদা চৌধুরী

চলতি বছরে ১১ সেপ্টেম্বর প্রবীণ রাজনীতিবিদ, জাতীয় সংসদের উপনেতা, আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মারা যান। সাজেদা চৌধুরী ১৯৫৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৯-১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৭৬ সালে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও তিনি পালন করছিলেন।

ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত 

ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান। বার্ধ্যক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগেছেন তিনি।

১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন ব্যারিস্টার হাসনাত। ১৯৯০ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলে তার প্রথম কমিটির সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার হাসনাত। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার এবং এইচ এরশাদের মন্ত্রিসভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং উপনির্বাচনে ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদের পতনের পরপরই জাতীয় পার্টি ছেড়ে আবার বিএনপিতে যোগ দেন ব্যারিস্টার হাসনাত এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য হন।

তোয়াব খান

২০২২ সালের ১ অক্টোবর একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খান মারা যান। এ সময় তার বয়স ছিল ৮৭ বছর। এর আগে, বার্ধক্যজনিত জটিলতায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় নিউজ পোর্টাল নিউজবাংলা ও দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন তিনি।

তিনি ২০১৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। একই বছর তাকে বাংলা একাডেমি সম্মানিত ফেলো নির্বাচিত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন তোয়াব খান। পরে এইচ এম এরশাদ এবং প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিবের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক পাকিস্তান থেকে বদলে যাওয়া দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন তোয়াব খান। দেশের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও প্রেস ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন যশস্বী এ সাংবাদিক। নিউজবাংলা ও দৈনিক বাংলার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন তিনি।

আলী ইমাম

বিশিষ্ট লেখক, শিশুসাহিত্যিক, সংগঠক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম চলতি বছরের ২১ নভেম্বর মারা যান। মৃদু স্ট্রোকসহ শরীরের নানা জটিলতাসহ শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা, সঙ্গে নিউমোনিয়া ও নিম্ন রক্তচাপ ছিল আলী ইমামের। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

তিনি ছয়শোরও বেশি বইয়ের লেখক। কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে একাধিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের আগে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন (২০০৪-২০০৬) ও অধুনালুপ্ত চ্যানেল ওয়ানের (২০০৭-২০০৮) মহাব্যবস্থাপক ছিলেন।

১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিসেফের ‘মা ও শিশুর উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম প্রকল্প’ পরিচালক ছিলেন। ওই দায়িত্ব পালনকালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, জার্মানির মিউনিখ, ব্রাজিলের রিওতে অনুষ্ঠিত ‘চিলড্রেন মিডিয়া সামিটে’ যোগ দেন। মিউনিখে অনুষ্ঠিত ‘প্রি জুঁনেসি চিলড্রেনস টিভি প্রোডাকশন প্রতিযোগিতা’র (২০০০) জুরির দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য আলী ইমাম ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১২ সালে শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার পান। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ২০০৪ সালে তিনি জাপান পরিভ্রমণ করেন।

Link copied!