প্রতিদিন রুটিন মাফিক রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় সড়কের শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. সাব্বির আহমেদ। চাকরি জীবনে পাঁচ বছর পার করেছেন তিনি। বিশৃঙ্খল সড়কের অবৈধ হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার, মাইকের ব্যবহার, বিভিন্ন প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত মাইকের শব্দে তার মেজাজ হয়েছে খিটখিটে। দুপুরে তীব্র রোদ আর অনিয়ন্ত্রিত হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ নিয়ে সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রতিদিন আট ঘণ্টা ডিউটি শেষে বাসায় ফিরলে মনে হয় কানে কেউ যেন বোঁ বোঁ করছে। আমার ২ বছর বয়সের একমাত্র সন্তানের কান্না অসহ্য লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক কথায় মেজাজ হারিয়ে ফেলছি। সারাদিন মনে হয়, সবাই আমার সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলছে।
মো. সাব্বির রহমানের মতো ঢাকা শহরের সবগুলো সড়কের ট্রাফিক সার্জেন্ট থেকে শুরু করে সড়কের পাশে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কমবেশি সবাই এমন সমস্যায় ভুগছেন। কেউ কেউ উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা ব্যাধিতে ভুগছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় শব্দদূষণের বেশি ভুগছে ট্রাফিক পুলিশ ও রাস্তার পাশে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। এই মুহূর্তে শব্দদূষণের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, দূষণ রোধে যেসব কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি অন্যতম।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, শব্দদূষণের কারণে একজন সাধারণ মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। অতিরিক্ত শব্দ ও কোলাহলে অসহ্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা অনুভূত হয়। অবিরাম তীব্র শব্দ মানসিক উত্তেজনা বাড়ায় ও মেজাজ খিটখিটে করে। এ দূষণের ফলে বমি বমি ভাব, ক্ষুধা মন্দা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্কের জটিল রোগ, অনিদ্রাজনিত অসুস্থতা, ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া, কর্মদক্ষতা হ্রাস, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মাথা ঘোরা ইত্যাদির প্রভাব সৃষ্টি করে।
দেখা গেছে, দেশে শব্দদূষণের ৭০ শতাংশ উৎস যানবাহন। এ শব্দ দূষণের ফলে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া সাধারণভাবে মোবাইলফোনে কথা শুনতে অসুবিধা হয় তাদের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশের। কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করলে ৮ দশমিক ২ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ মাথা বনবন করা, বমি বমি ভাব ও ক্লান্তির সমস্যায় ভোগেন। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) সমীক্ষায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, দেশে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ থাকলেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ যানবাহনে অবৈধভাবে এ হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। চোরাই পথে আসা ও স্থানীয়ভাবে হাইড্রোলিক হর্নে উৎপাদন ঠেকাতে না পারলে সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শব্দদূষণের অন্যতম উৎস সড়কে হর্ন বাজানো। আর এই হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি রোধে আমদানি নীতি আদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রণয়ন করা হলেও তার প্রয়োগ নেই বলেই চলে। যেসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে এসব হর্ন আমদানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা এবং আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫, ২০১৮ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেই কোনো সমন্বয়।
কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার প্রধান সড়কের ফুটপাতে মোবাইলের খুচরা সামগ্রী বিক্রি করেন আকতার হোসেন। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রতিদিন এই সড়ক দিয়ে হাজার হাজার গাড়ি যাতায়াত করে। এর মধ্যে ভিআইপি গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচলও থাকে অনেক বেশি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফুটপাতে থাকতে হয়। গাড়ির হর্ন আর শব্দে সবসময় মাথা ব্যাথা লেগে থাকে। বাসায় গেলে কেউ কথা বললে শুনতে পাই না। মনে হয় আস্তে আস্তে সবাই কথা বলছে।”
পান্থপথ এলাকার এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সড়কে সিগন্যাল পড়লে অযথা গাড়ি চালকরা সজোরে হর্ন বাজাতে শুরু করে। বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং শুরু হওয়ার পর কার আগে কে গন্তব্য যাবে, এই প্রতিযোগিতায় সিগন্যাল দিলেই হর্ন বাজাতে থাকে। অযথা হর্ন বাজানোর কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের কানে একধরনের শব্দ হচ্ছে। রাতে ঘুমালেও মনে হয় কেউ কানের সামনে শব্দ করছে। মেজাজও দিন দিন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।”
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “শব্দদূষণ রীতিমতো শব্দসন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে। শব্দ কোথাও সহনীয় মাত্রায় নেই। হাসপাতাল এলাকায় শব্দের মাত্রা যেখানে ৪৫ ডেসিমেলে থাকার কথা, সেখানে ১০০ ডেসিমেলের নিচে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে অতি উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম এবং আতশবাজির শব্দও সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে রাস্তায় কাজ করা ট্রাফিক পুলিশ, রিকশাচালক ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা এই শব্দ দূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
আবু নাসের খান আরও বলেন, “যানচালকদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, অননুমোদিত যন্ত্রপাতি আমদানি এবং যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্নই শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। এই শব্দসন্ত্রাস প্রতিরোধে ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
নগরীর এমন শব্দদূষণ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল খান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকা মহানগরীতে প্রতি বছর বিআরটিএ প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে। এসব যানবাহনে যত্রতত্র সাউন্ড বক্স মাইকের মাধ্যমে উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি শব্দদূষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার এখনই সময়। ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইন, বিধি বাস্তবায়ন ও দ্বিরুক্ত শব্দ করা থেকে বিরত থাকার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে।”
ড. আদিল খান আরও বলেন, “শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ত্রুটিপূর্ণ বা মেয়াদোত্তীর্ণ যানচলাচল বন্ধ এবং অনুমোদনহীন মোটর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। হর্ন বাজানো ড্রাইভারদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রয়োজন। বিআরটিএর ট্রেনিংয়ে ‘নো হর্ন’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভারদের হর্ন না বাজানো ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “নগরীতে শব্দদূষণের ফলে মানুষের মারাত্মক মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ব্যথা, বধির হওয়া, আতঙ্কগ্রস্ত, অনিদ্রা ইত্যাদি। এই দূষণের কারণে দাপ্তরিক কাজ, শিক্ষা কার্যক্রম, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ, রিকশাচালক, হকাররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে।”
ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, “বর্তমানে শব্দদূষণ মারাত্মক অবস্থা ধারণ করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও যানবাহন চলাচল, নির্মাণকাজ এবং বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সচেতন হতে হবে।”
আপনার মতামত লিখুন :