• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সাবেক এমপি-মন্ত্রীর সন্তানদের মূল্যায়নের চিন্তা আ.লীগে


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৩, ০৯:৪৩ পিএম
সাবেক এমপি-মন্ত্রীর সন্তানদের মূল্যায়নের চিন্তা আ.লীগে
ছবি : সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার নৌকা প্রতীক দিয়ে সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের মূল্যায়ন করবেন দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বিতর্কিত ও অভিযোগ উঠা প্রায় শতাধিক এমপি-মন্ত্রী এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হতে পারেন।

জানা গেছে, দলীয় কোন্দল সৃষ্টি, বলয়ভিত্তিক রাজনীতি, ত্যাগীদের অবমূল্যায়নসহ নানা অভিযোগে দলটির মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এমন অবস্থায় নিজেদের অবস্থান ফিরে পেতে মরিয়া ক্ষমতাসীন দলটির সাবেক এমপি-মন্ত্রীর স্ত্রী, সন্তান, ভাই ও আত্মীয়স্বজনরা।

নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেতে ইতোমধ্যেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তারা। নির্বাচনী এলাকায় কর্মীসভা, পথসভা, মতবিনিময় সভা, উন্নয়ন সভা ও গণসংযোগের মাধ্যমে তারা জানান দিচ্ছেন নিজেদের অবস্থান। কাছে টানছেন দলের দুর্দিনের পরীক্ষিত, ত্যাগী, পরিশ্রমী ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের। 
নৌকার মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেই মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। তাদের পদচারণায় সরগরম এখন তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতি।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের  সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা রাজপথেও আছি নির্বাচনেও আছি। নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে আগামী নির্বাচনের জন্য নেতারা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। আগামীতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। আশা করি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে। তারা নির্বাচনে আসলে স্বাগত জানাব। তবে শুনেছি বিএনপি আন্দোলন করছে, আবার তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে।

এদিকে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতারাও। দলীয় মনোনয়ন পেতে জোরেশোরে মাঠে নেমেছেন তারা। আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে দেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

টানা চতুর্থ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ। ভোটের মাঠে দলীয় প্রতীকের বিজয় নিশ্চিত করতে বিতর্কিত এমপি-মন্ত্রীদের মনোনয়ন দেবে না দলটি। ইতোমধ্যেই এমন ঘোষণা দিয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেসব বিষয় মাথায় রেখেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে নৌকা পাবেন না এলাকা বিচ্ছিন্ন, গডফাদার বনে যাওয়া, আওয়ামী লীগকে মাইনাস করে ‘এমপি লীগ’, ‘ভাই লীগ’ বা ‘ভাবি লীগ’, ‘আত্মীয় লীগ’ এবং সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তোলা এমপিরা।

ক্লিন ইমেজের নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে এবার। এ নির্বাচনে মূল্যায়ন করা হতে পারে সাবেক এমপি-মন্ত্রী পরিবারের সদস্যদের। যাদের পরিবারের দলের জন্য অনেক ত্যাগ রয়েছে। যারা দলের দুর্দিনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বিএনপি-জামায়ত জোট সরকারের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সেসব সাবেক এমপি-মন্ত্রীর ছেলে-মেয়েদের মূল্যায়ন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে দলটির একাধিক সূত্র।    

অনুসন্ধানে জানা যায়, পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনের টানা পাঁচবারের এমপি, ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু ২০২০ সালের ২ এপ্রিল মারা যান।

এ আসনের উপনির্বাচনে তার ছেলে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গালিবুর রহমান শরীফ দলীয় মনোনয়ন চেয়েও বঞ্চিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তিনি। টানা পাঁচবারের এমপি ডিলুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে গালিবকে দলের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান তৃণমূল নেতাকর্মীরা। গালিবও প্রায় প্রতিদিন নির্বাচনী এলাকার গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার চষে বেড়াচ্ছেন। কর্মীসভা, পথসভা, মতবিনিময় সভা, উন্নয়ন সভা, নারী সমাবেশের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে  পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গালিবুর রহমান শরীফ বলেন, আমার প্রয়াত পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দলীয় নেতাকর্মীরা আমাকে দেখতে চান। আমি উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরছি, গণসংযোগ করছি। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তরুণ নেতৃত্ব বেছে নেবেন বলে আশা করি। নেত্রী যদি আমাকে নৌকা দেন, তাহলে পিতার ধারাবাহিকতায় আমিও নেত্রীর হাতকে শক্তিশালী করবো, নৌকার জয় উপহার দেব। একই সঙ্গে আমার পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করবো।  

ঢাকা-৫ আসনের চারবারের সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন কাজী মনিরুল ইসলাম মনু। তবে নির্বাচিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তিনি। নানা অপকর্ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে তার। দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় বাবার আসনে নৌকার হাল ধরতে চান হাবিবুর রহমান মোল্লার জ্যেষ্ঠপুত্র মশিউর রহমান সজল। তিনি ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

ইতোমধ্যেই ঢাকা-৫ নির্বাচনী এলাকায়  সরকারের টানা তিন মেয়াদের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে ওঠান বৈঠক করছেন এবং ভোটের মাঠে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। প্রতিদিনই উন্নয়ন ও শান্তি সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন মশিউর রহমান মোল্লা সজল।

জানতে চাইলে মশিউর রহমান মোল্লা সজল বলেন, “বাবা ছিলেন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত রাজনীতিবিদ। নৌকা প্রতীক নিয়ে কয়েকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তার অনেক কর্মী-সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। সবাইকে নিয়েই আমি কাজ করছি।”

নওগাঁ-৬ আসনের এমপি মো. ইসরাফিল আলম মারা যাওয়ার পর এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন মো. আনোয়ার হোসেন হেলাল। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরই প্রয়াত ইসরাফিল আলমের সমর্থকদের কোণঠাসা করে ফেলেন। সৃষ্টি করেন বলয়ভিত্তিক রাজনীতি। তৈরি করেন ভাই লীগ, এমপি লীগ। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

আসন্ন নির্বাচনে এ আসনে নৌকার মনোনয়ন চান প্রয়াত এমপি ইসরাফিল আলমের স্ত্রী সুলতানা পারভিন বিউটি। তিনি নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি। বিউটি স্বামীর রেখে যাওয়া কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তিনি জানান, দলের জন্য তার স্বামীর অনেক ত্যাগ ও পরিশ্রম রয়েছে। ফলে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হয়ে স্বামীর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চান তিনি।

সিরাজগঞ্জ-১ ও সিরাজগঞ্জ-২ এই দুটি আসন থেকেই নৌকার মনোনয়ন চান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত ড. মোহাম্মদ সেলিমের পুত্র মো. শেহেরিন সেলিম রিপন। ইতোমধ্যেই নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ, কর্মীসভা ও দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছেন তিনি। প্রায় প্রতিদিন নির্বাচনী এলাকার গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, “দলের কর্মী-সমর্থকরা আমার পাশে আছেন। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নৌকার মনোনয়ন দেবেন।”

নাটোর-৪ আসনের দীর্ঘদিন এমপি ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস। দলের দুঃসময়ে ও দুর্দিনের পরীক্ষিত নেতা ছিলেন তিনি। আসন্ন নির্বাচনে তার আসনে নৌকার মনোনয়ন চান তার মেয়ে কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও যুব মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি।

সিরাজগঞ্জ-৩ (তাড়াশ-রায়গঞ্জ) আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন হোসনে আরা পারভীন লাভলী। তিনি প্রয়াত সংসদ সদস্য গাজী ম.ম. আমজাদ হোসেন মিলনের কন্যা ও তাড়াশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন তিনি।

জানতে চাইলে হোসনে আরা পারভীন লাভলী বলেন, আমার বাবা এই আসনের এমপি ছিলেন। তিনি দল ও দলীয় কর্মীদের জন্য নিবেদিত ছিলেন। এই আসনের অনেক উন্নয়ন তিনি নিজ হাতে করেছেন। বাবার দেখানো পথেই রাজনীতি করছি। দলের কর্মী-সমর্থকরা আমার সাথে আছে।

ঢাকা-১৭ আসনে নৌকার মনোনয়ন চান সাবেক এমপি চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের ছেলে রৌশন হোসেন পাঠান। এই আসনে উপনির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও সাবেক অনেক এমপির ভাই, আত্মীয়স্বজনরা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।

এদিকে নৌকা প্রতিকের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতারা। দলীয় মনোনয়ন পেতে জোরেশোরে মাঠে নেমেছেন তারাও। সিলেট-৩ আসনের বর্তমান এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা। এবার এ আসনে হাবিবের সঙ্গে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী নেতারাও নৌকার প্রতীকের লড়াইয়ে আছেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মুহাম্মদ মনির হোসাইন ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক আ স ম মিসবাহও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

Link copied!