শুক্রবার (১১ আগস্ট) রাজধানীতে দুটি গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ঘোষণা অনুযায়ী বিএনপির সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে যুক্ত থাকা জোট ও সমমনা অন্য দলগুলোও এই কর্মসূচি পালন করবে।
তবে দলটির নেতাদের মধ্যে কর্মসূচি পালন নিয়ে যখন বিরোধ চলছে, তখনই মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। বিরোধের কারণ ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে কর্মসূচি পালনে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা। এই সমন্বয়হীনতার কারণে হাইকমান্ডের তোপের মুখে আছেন কয়েক নেতা। এরই মধ্যে দলটির একটি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদ হারিয়েছেন এক নেতা। আরও কয়েকজনকে মৌখিকভাবে ‘তিরস্কার’ করা হয়েছে হাইকমান্ড থেকে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে চলছে গুঞ্জন।
বিএনপির এসব দ্বন্দ্ব আর সমন্বয়হীনতার খবর প্রকাশ হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির বাংলা বিভাগে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা ওই গণমাধ্যমকে বলেছেন, ২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচির পর সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে কর্মসূচি সফল করার জন্য ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনুপস্থিতি ও সমন্বয়হীনতা’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
২৮ জুলাই নয়াপল্টনের জনসভায় হাজার হাজার নেতা-কর্মী যোগ দিলেও ঠিক এর পরদিন ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে সেটি দেখা যায়নি। এজন্য বিএনপি নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, কেন কর্মসূচি সফল করা যায়নি?
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন, দলের নেতাদের কারও সদিচ্ছার অভাব ছিল না, কিন্তু সমন্বয়হীনতার বিষয় ছিল। অনেকে হয়তো নানা বাস্তব কারণেই যথাসময়ে নির্ধারিত স্থানে আসতে পারেননি। কিন্তু একটি ঘটনার পর অন্য কেউ হাল ধরে বাকিদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারেননি। গাবতলীর ঘটনাই দেখুন। আমান সাহেব আটক হওয়ার পর আর কেউ দায়িত্ব নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কমিউনিকেট করেনি। এভাবেই বিবিসি বাংলাকে বলেছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
বিএনপির এই নেতা (গয়েশ্বর চন্দ্র রায়) ২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে প্রথমে পুলিশের হামলায় আহত হন এবং পরে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজন করে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলেন।
ওই দিন গয়েশ্বর ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আমানউল্লাহ আমানকে সক্রিয় দেখা গেছে। তিনিও অসুস্থ হয়ে পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রতিনিধিদল। এর বাইরে দলের ওই দিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনেককেই যেখানে থাকার কথা সেখানে দেখা যায়নি বলে বলছেন দলের নেতারাই।
বিএনপির একাধিক নেতা গণমাধ্যমটিকে আরও জানিয়েছেন, ২৮ জুলাইয়ের জনসভার ঠিক পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিল যাতে করে ‘বিপুলসংখ্যক কর্মী সমর্থকদের উপস্থিতিতে আরেকটি বড় ধরনের শোডাউন’ দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। পরে ৩১ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আমানউল্লাহ আমান তার ভাষণে দলের স্থায়ী কমিটির সব সদস্যদের প্রতিও দলীয় কর্মসূচির সময়ে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান।
জানা যায়, দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক থেকে পুরো কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভারতের শিলংয়ে থাকা স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে কে কোথায় অবস্থান করবেন এবং প্রথম দিকে কেউ বাধাপ্রাপ্ত হলে পরবর্তী সময়ে কারা এগিয়ে যাবেন, তেমন পরিকল্পনা করে দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।
নেতাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দলের সিনিয়র নেতারা মূল পয়েন্টগুলোতে থাকবেন কিন্তু জমায়েত সফল করা এবং প্রয়োজনে ‘বাধার মুখে টিকে থাকার’ জন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা এবং ঢাকা মহানগরের নেতাদের ওপর ভরসা করা হলেও সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি এসব নেতাদের সক্রিয় উপস্থিতি না থাকার কারণে।
নাম না প্রকাশের অনুরোধে একাধিক নেতা গণমাধ্যমটিকে আরও জানিয়েছেন, বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ক্ষুব্ধ করেছে। যার বহি:প্রকাশ ঘটেছে পরে সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। এর আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা অবস্থান কর্মসূচির দিনে কে কোথায় ছিলেন, সে সম্পর্কিত ভিডিওগুলো সংগ্রহ করেন ও খোঁজখবর নেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে ‘দ্রুত নিজেদের মধ্যে ঝামেলা’ মিটিয়ে ফেলার জন্য দলীয় নেতাদের অনুরোধ করেছেন বলেও জানা গেছে।
অন্যদিকে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন-এমন কয়েকজনের সঙ্গে নিজে কথা বলে তার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন, যা নিয়ে এখন দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
অপরদিকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের একজন রুহুল কুদ্দুস তালুকদার বলছেন “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী অবস্থানসহ নানা বাস্তব কারণে অনেকে চেষ্টা করেও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না অনেক সময়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটি দলের মধ্যে কোনো হতাশা তৈরি করেছে।”
তবে ওই কর্মসূচির এক সপ্তাহের মাথায় ছাত্রদল সভাপতির পদ থেকে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে। তাকে অসুস্থ বলা হলেও মূলত তাকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশের সময়েও তিনি দলীয় কার্যালয়ে সুস্থই ছিলেন বলে জানা গেছে।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার বলছেন, “গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের স্বার্থে যে কাউকেই তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন বা কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন। কিন্তু নেতারা যা-ই বলুন না কেন, দলের অভ্যন্তরে এখন বড় আলোচনার বিষয় হলো – জনসভাগুলোতে বিপুল উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেও ‘বাধা আসতে পারে এমন কর্মসূচি’তে নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের আনা যাচ্ছে না কেন?”
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “জনসভাগুলো শান্তিপূর্ণ হয় বলে সেখানে সব বয়সের মানুষ উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু যেসব কর্মসূচিতে পুলিশ বা সরকারি দলের হামলার সম্ভাবনা থাকে সেখানে সেটা সম্ভব হয় না। সবাই তো সব কর্মসূচিতে থাকতে পারবে না। তবে এখন যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে সেটার যৌক্তিক কারণও আছে। অনেকে মামলার কারণে আত্মগোপনে। ফোনে কথা বলাও রিস্ক হয়ে যায় অনেক সময়।”
তবে এই নেতার আশা, বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নজরে আসায় দল থেকে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিতের কারণে সামনের কর্মসূচিগুলো আরও সুসংগঠিত হবে।
গয়েশ্বর চন্দ্র আরও বলেন, “রাজনৈতিক দলে এটি স্বাভাবিক চিত্র। দল নিয়মিতই অবস্থা পর্যালোচনা করছে ও করবে। অনেক সময় কৌশলও পাল্টাতে হয়। অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আমাদের কর্মী সমর্থকরা এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।” সূত্র : বিবিসি বাংলা