• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

গরমে প্রাণীদের কী অবস্থা?


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ০৯:৫৬ পিএম
গরমে প্রাণীদের কী অবস্থা?
দাবদাহে ধুঁকছে প্রাণীরা। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

আগুন ঝরা রোদের সঙ্গে অসহনীয় গরম। চারদিকে ব্যস্ত মানুষের গন্তব্যে যাওয়ার ছুটোছুটি। কারও মাথায় ছাতা, হাতে পানির বোতল। যেখানে ছায়া সেখানেই জটলা। এর মধ্যেই দূর থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন পোষা প্রাণীর চিৎকার। বলছিলাম রাজধানীর পাখির মার্কেটখ্যাত কাঁটাবনের কথা। যেখানে পাওয়া যায় কুকুর, বিড়াল, পাখি, মাছসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। খাঁচায় বন্দি এসব প্রাণী কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসেন পশুপ্রেমীরা।

শনিবার (২৭ এপ্রিল) কাঁটাবনে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে খাঁচায় বন্দি প্রাণীরা। বিক্রেতারা প্রাণীদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করলেও স্বস্তি নেই। গরম সহ্য করতে না পেরে খাঁচার মধ্যেই চিৎকার, ছুটোছুটি করছে কুকুর, বিড়াল, পাখিরা। একটু স্বস্তি দিতে অনেক দোকানি খাঁচাগুলো খোলামেলা জায়গায় রাখলেও শান্ত হচ্ছে না প্রাণীরা। ফলে প্রাণীদের চরম বিপাকে পড়েছেন কাঁটাবনের দোকানিরা।

আব্দুল কাদের নামের এক দোকানি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ফ্যান দুইটা করে লাগিয়েছি। কিন্তু ফ্যানের গরম বাতাসে আরও চিৎকার চেঁচামেচি করছে প্রাণীরা। এদের শরীর ধোয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবে তা দিয়েও কাজ হচ্ছে না।”

এ চিত্র তো কাঁটাবনের খাঁচায় বন্দি প্রাণীদের। তবে ঢাকার দুই সিটির বেওয়ারিস প্রাণীদের অবস্থা আরও করুণ। গরমে বেওয়ারিশ কুকুরদের জন্য নেই পানির ব্যবস্থা। প্রচণ্ড গরমে ধুঁকছে বেশিরভাগ প্রাণী। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সড়কের গাছের সঙ্গে পানি ও খাবারের পাত্র বেঁধে দেওয়া হয়েছে। প্রাণীদের জন্য এমন মানবতার কর্মকাণ্ড প্রশংসা কুড়াচ্ছে। যদিও পাখিদের জন্য গাছের ডালে কিংবা বাসা-বাড়ির ছাদে এমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না।

দাবদাহে ধুঁকছে প্রাণীরা। ছবি : সংবাদ প্রকাশ

প্রাণিবিদরা বলছেন, তীব্র গরমে মানুষের মতো প্রাণিদেরও কষ্ট হয়। বাঁচার জন্য প্রাণীরাও নিজস্ব কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি হলেই মানুষ ঘামতে থাকে; শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে গেলে দেহ শীতল হয়। ঠিক একইভাবে প্রাণীদের শরীর শীতল করার জন্যও তারা বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। তবে এতকিছুর পরও ভয়াবহ তাপপ্রবাহে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া যায়, যা প্রাণীদের সুরক্ষায় সহায়ক হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, “তীব্র গরমে জলাধারগুলো শুকিয়ে যায়। পানি পানের উৎস সংকুচিত হয়ে আসে। তখন পানির অভাবই প্রাণীদের কষ্টের বড় কারণ। এসব প্রাণীরা বাধ্য হয়ে জনবসতির কাছে গিয়ে ধরাও পড়ে। গরম থেকে রেহাই পেতে প্রাণীরা ছায়াময় জায়গায় আশ্রয় নেয় বা শরীর পানিতে ডুবিয়ে রাখে। পাখিদের ক্ষেত্রে পাখা ও পালক ভিজিয়ে গা ঠান্ডা করে। ডিম থাকলে বাবা কিংবা মা পাখি ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখে। নিজেদের শরীর ভিজিয়ে এনেও তারা ডিম ঠান্ডা রাখে।”

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদ থেকে বাঁচতে যেখানে ছায়া সেখানেই বসে বিশ্রাম নিচ্ছে বেওয়ারিশ কুকুর। তবে চা কিংবা খাবারের দোকানগুলোর সামনেও এদের দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ রুটি কিংবা বিস্কুট কিনে ছুড়ে দেন। তবে প্রাণিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে মাংসাশী প্রাণীরা।

অনেক প্রাণী ধারে কাছে কোনো পানির উৎস পেলে তাতে মুখ ডুবিয়ে স্বস্তি নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাপর ছুটে যাচ্ছে শীতল পরিবেশের খোঁজে গাছের ছায়ায়। অনেক প্রাণী আবার গরম সহ্য করতে না পেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পিপাসায় কাতর হয়ে পানির সন্ধানে উড়ছে অনেক পাখি।

তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রাণীদের চেয়ে খানিকটা স্বস্তিতে রয়েছে জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীরা। সবুজ প্রকৃতিতে ঘেরা থাকায় চিড়িয়াখানার পরিবেশ অনেকটা শীতল। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, দাবদাহে মানুষের মতো প্রাণিদেরও হিটস্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে। তাই প্রাণীদের দিনে ২-৩ বার পর্যন্ত গোসল করানো হচ্ছে। ছিটানো হচ্ছে ঠান্ডা পানি। পরিবর্তন করা হয়েছে খাদ্যাভাসের। খাবার পানিতে দেওয়া হচ্ছে স্যালাইনও।

‘গরমে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে’, এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে মানুষের মতো প্রাণিকুলের মধ্যেও অস্বস্তি বিরাজ করছে। চিড়িয়াখানার প্রাণীদের নানাভাবে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। খাবার পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে।”

প্রাণীদের খাবারের বিষয়ে ড. মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ইলেকট্রোলাইট দেওয়া হচ্ছে, ভিটামিন-সি দেওয়া হচ্ছে। খাদ্যাভাসে কিছুটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে তরল খাবার বেশি দেওয়া, সহজে হজম হয় এই ধরনের খাবার দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রাণিগুলো এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে।”

সূত্রমতে, সপ্তাহ দুয়েক ধরেই ঢাকার তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। কখনো ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কখনো ৪০ ডিগ্রির বেশি। তবে অনুভবের তীব্রতা আরও বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের হিমশিম অবস্থা। তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলও অস্থির হয়ে উঠেছে।

প্রাণীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে পশুপ্রেমী তরুণদের নিয়ে গড়া পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার বা প-ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন। নেতৃত্বে রয়েছেন স্থপতি রাকিবুল ইসলাম এমিল। তিনি বলেন, “গরমে যেখানে মানুষের টেকা দায় সেখানে প্রাণীদের অবস্থা কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। বেওয়ারিশ কুকুরদের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পানি পানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশেষ করে মাংসাশী প্রাণীদের জন্য সংগঠন কাজ করছে।”

স্থপতি রাকিবুল ইসলাম আরও বলেন, “এই গরমে প্রাণীদের জন্য মানবিক দৃষ্টি বেশি জরুরি। মানুষ কষ্টের কথা বলতে পারলেও প্রাণীরা বলতে পারে না। তাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এসব অসহায় প্রাণীর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন।”

Link copied!