• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬ বছরে ১৮৫ খুন


কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৩, ০৭:২৩ পিএম
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬ বছরে ১৮৫ খুন
ফাইল ছবি

দিন দিন অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। হত্যা, গুম, অপরহরণ, মাদক ব্যবসাসহ সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এই ক্যাম্পে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে গত এক বছরে ৮৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে। গত বছর ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৫ বছরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ১০১টি। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে, অস্ত্র, মাদক চোরাচালান, গুম, খুন, অপহরণ ও ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার।

১২ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। সেই সংখ্যা এখন দিনে দিনে প্রায় ১৫ লাখে ঠেকেছে।

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া তথ্যে জানা যায়, দৈনিক ১৩০ থেকে ১৩৫ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তাই বহুমুখী সমস্যা ও সংকটের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে বেড়ে চলছে অপরাধের মাত্রা।

মিয়ানমারের মদদেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে আরএসও, আরসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী। সংঘটিত হচ্ছে নানা অপকর্ম। শুধুমাত্র চলতি বছরেই ৫৩ জন খুন হয়েছেন। ফলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দিন দিন বেড়েই চলেছে অস্থিরতা। বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কিংবা মিয়ানমারবিরোধী কোনো ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা হলে বা কোনো প্রতিনিধিদল পরিদর্শনে এলেই ক্যাম্পে খুনোখুনি ও অরাজকতা বেড়ে যায়।

রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারই এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দিয়ে এসব ঘটাচ্ছে তারা।

আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পে সক্রিয় থাকা মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

গত ৬ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্প পরিদর্শনে যায়। দলটি কুতুপালং ১ নম্বর পশ্চিম ক্যাম্পের এ/১ ব্লক পরিদর্শনকালে একই ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে এবাদুল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গাকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনা ঘটে। তিনি ওই ব্লকের উপ-প্রধানের (সাব মাঝি) দায়িত্ব পালন করতেন।

পরদিন ৭ জুলাই (শুক্রবার) ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্প-৮ ইস্টের পাহাড়ি এলাকায় আরএসও ও আরসার সন্ত্রাসীদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। ঘটনাস্থলে এপিবিএন পৌঁছালে পালিয়ে যান দুই গ্রুপের সদস্যরা। তবে গোলাগুলিতে প্রাণ যায় ছয় জনের।

এপিবিএন জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে পাঁচজন আরসা সদস্য। একই ক্যাম্প থেকে বিকেলে আরও এক রোহিঙ্গার গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

রোহিঙ্গাদের দাবি, ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। তারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এ জন্য তারা সব সময় ভয়ে থাকেন। প্রশাসনকে জানালে গলা কেটে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করেছে আরসা। মিয়ানমারই এসব গ্রুপকে দিয়ে ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করাচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৫৩ জন, যাদের মধ্যে ৩৫ জনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনায় জড়িত নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক। তারা নানাভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হতে কাজ করেছেন। 

শুধু গত এক বছরে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ১৭৬জনকে গ্রেপ্তার ও চার শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। এর বাইরেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আলোচনা ঠেকাতে অনেক ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২২২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে।

এছাড়াও গত ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিবুল্লাহকে। তিনি রোহিঙ্গা অধিকারের পক্ষে কথা বলে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। এর নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী বলা হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনিকে।

গত ২১ জুলাই শুক্রবার আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদসহ আরসার ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এ ছয়জন খুন ও অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।

তারা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে সক্রিয় রয়েছে আরসার ৪৫০ সন্ত্রাসী। এরা গহীন পাহাড়ে আস্তানা তৈরি করে টর্চারসেল গড়ে তুলে অপহরণ ছাড়াও নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় এমনকি হত্যার পর মরদেহ গুম করে থাকে।

নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে আরসার ৩০-৩৫ জন সদস্য কুতুপালং ক্যাম্প ও তার আশপাশের এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে আসছে। এ সব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী দেশ হতে দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করেন।

নুর মোহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করতো। চাঁদার অর্থ না পেলে অপহরণ, শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করতেন। মুক্তিপণ না পেলে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতেন।
এই নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বেই ক্যাম্পে হেড মাঝি শফি উল্লাহ্ হত্যাকাণ্ড, সালাম হত্যাকাণ্ড, সলিম হত্যাকাণ্ড, মালেক হত্যাকাণ্ড, হাবুইয়া হত্যাকাণ্ড ইমান হত্যাকাণ্ড, আবুল মুনসুর হত্যাকাণ্ড, সালেহ্ হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক এক নারীর ঘরে প্রবেশের সময় মহিলা বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ছয়জন হত্যাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে।

গ্রেপ্তার আরসার সদস্য মো. হোসেন জোহার হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা, সাবমাঝি সৈয়দ হোছেনকে গুলি করে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী হিসেবে জড়িত ছিলেন।

ফারুক হারেস আরসার প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী ও টর্চারসেলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তার ৭-৮ জনের একটি ‘নেট গ্রুপ’ রয়েছে। যারা নিয়মিত ক্যাম্পের প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের কাছে রিপোর্ট দিতেন।

আর মনির আহাম্মদ, নূর ইসলাম ও ইয়াছিন পাহাড়ে অবস্থিত গোপন আরসা ঘাঁটির নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতেন। যেখানে অপহরণ করে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

প্রশাসনের পাশাপাশি ক্যাম্পের এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত স্থানীয়রাও। অপরাধ দমনে যৌথ অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

উখিয়ার রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও কুতুপালংয়ের রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, “রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলো যেভাবে ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরি করছে, তাতে স্থানীয়রাও আতঙ্কে রয়েছেন। আমরা চাই, ক্যাম্পে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক। প্রয়োজনে সব বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে ক্যাম্প থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আইনের আওতায় আনা হোক।”

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, “ক্যাম্পে সংঘটিত অপরাধ কর্মকাণ্ডে মিয়ানমারের মদদ রয়েছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইস আনাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। প্রত্যাবাসন ঠেকানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য।”

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আরসা অস্ত্র সংগ্রহ করে। এরপর ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে। অপরাধ সংঘটিত করে ভারী অস্ত্রগুলো আবার তারা লুকিয়ে রাখে। ক্যাম্পে আরসার ৪০০ থেকে ৪৫০ সদস্য রয়েছেন। তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”

Link copied!